‘রন্থ’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি
‘রন্থ’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

পুলিশের দুর্নীতি আর নির্মম পরিণতির গল্প

মালয়ালম চিত্রনাট্যকার–নির্মাতা শাহী কবির আগে ছিলেন পুলিশ সদস্য। তাই সিনেমা বানাতে এসে বারবার বেছে নেন পুলিশি–দুনিয়ার গল্প। নিজে পুলিশ সদস্য হওয়ায় তাঁর গল্পে উঠে আসে পর্দায় দেখা নায়কোচিত পুলিশের ভিন্ন রূপ। কখনো সেটা পুলিশি তদন্ত ধারার সিনেমার মোড়কে, কখনো আবার মানবিক সম্পর্কের দিক উন্মোচিত করে। ‘জোসেফ’, নায়াত্তু’, ‘অফিসার অন ডিউনি’ থেকে ‘এলা ভিজহা পুনছিরা’ চিত্রনাট্যকার বা নির্মাতা হিসেবে কবির যখনই কাজ করেছেন, তখনই পুলিশকে পাওয়া গেছে ভিন্নভাবে। নিজের পরিচালিত দ্বিতীয় সিনেমা ‘রন্থ’–এও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

একনজরেসিনেমা: ‘রন্থ’ধরন: ক্রাইম থ্রিলার, ড্রামাপরিচালনা: শাহী কবিরঅভিনয়ে: দীলেশ পোথান, রোশন ম্যাথিউ, অরুণ চেরুকাবিল, রোশান আব্দুল রাহুফস্ট্রিমিং: জিওহটস্টারদৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২ মিনিট

তবে এবার কোনো পুলিশি তদন্ত সিনেমা বানাননি কবির, দেখিয়েছেন এক রাতে প্যাট্রল ডিউটিতে থাকা দুই পুলিশ সদস্যের গল্প। এখানে অবশ্য গল্প কম; বরং পুরো সিনেমাটিই এক জার্নি। যে যাত্রার শেষ ১৫ মিনিট আপনাকে নাড়িয়ে দেবে। পুলিশি গল্প কতটা বাস্তবঘেঁষা হতে পারে, সেটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে। তিন বছর পর নির্মাতা হিসেবে কবিরের প্রত্যাবর্তন তাই হয়ে রইল স্মরণীয়।

সিনেমার গল্প নবীন আর বয়োজ্যেষ্ঠ দুই পুলিশ সদস্যকে নিয়ে। কপ সিনেমায় এ ধরনের জুটির বহু গল্প উঠে এসেছে। তবে ছকটা পশ্চিমা সিনেমা থেকে ধার করা হলেও সিনেমাটিতে এই অঞ্চলের গন্ধ স্পষ্ট। ইওহানন (দীলেশ পোথান) ও দিন্নাথ (রোশন ম্যাথিউ)—অভিজ্ঞ ও এক নবীন পুলিশ কর্মকর্তার সম্পর্কের সূক্ষ্ম রসায়ন প্রথমে আপনাকে ‘ট্রেনিং ডে’ কিংবা ‘সেভেন’–এর কথা মনে করাবে।

‘রন্থ’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

কেরালার প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাতের ডিউটিতে নেমে তাঁরা মুখোমুখি হন জাত–প্রথা নিয়ে দ্বন্দ্ব, দুর্ঘটনা, অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, এমনকি অতিপ্রাকৃত ভয়েরও। রাত ফুরিয়ে দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার মেজাজে ঘটে যায় ভয়াবহ এক রূপান্তর। যেন ‘জানে ভি দো ইয়ারো’ দেখতে দেখতে হঠাৎ ‘হেরেডিটারি’র মতো গা শিউরে ওঠা ক্লাইম্যাক্স ঢুকে পড়ে ‘রন্থ’।

ইওহানন পেশাগত নিষ্ঠুরতা আর অভিজ্ঞতায় ক্লান্ত। অন্যদিকে দিন্নাথ একেবারে নতুন ও আদর্শবাদী। এখনো সিস্টেমের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ‘ভূত’ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। কিন্তু পর্দায় দেখিয়েছেন, আদর্শবাদ হোক বা সংশয়—দুজনেই একই ব্যবস্থার শৃঙ্খলে বাঁধা। সিনেমার শুরুতেই দেখা যায়, ইওহানন জানালার শিকের ওপারে হাঁটছেন, এটা যেন প্রতীকী কারাবাস; যেখান থেকে মুক্তি নেই।

এক জায়গায় দেখা যায়, একটি ছোট দুর্ঘটনার পর ইওহানন এক পাদরির কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। তবে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, এটা ঘুষ নয়। পাদরির গাড়িতে হালকা মদ থাকার প্রমাণ পেয়েই তিনি তাঁর কাছ থেকে টাকা চান, যেটা নাকি পুলিশ জিপের মেরামতের জন্য দরকার। কারণ, অফিস থেকে রিফান্ড পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ছোট ছোট এই মুহূর্তগুলোই ‘রন্থ’–কে আলাদা করে তোলে। সিনেমাটি দেখে মনে হয় না, এটি সিনেমা; বরং এটি বাস্তব জীবনের এক ক্লান্ত ও প্রতিবিম্ব।

‘রন্থ’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

রাতভর দায়িত্ব পালনের সময় দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয় বারবার। কিন্তু শিশুদের প্রতি ইওহাননের নরম মনোভাবই সদ্য বাবা হওয়া দিন্নাথের সঙ্গে তাঁর এক সহানুভূতির সেতু গড়ে তোলে। দিন্নাথ যেভাবে নিজের সন্তান ও অসুস্থ মায়ের জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত, তা ইওহাননের কঠিন আবরণ ভেদ করে গভীর ছাপ ফেলে। ধীরে ধীরে বোঝা যায়, ইওহানন নিজেও একসময় আদর্শবাদী ছিলেন। স্ত্রীর সন্তান মৃত অবস্থায় জন্মেছিল, সেই শোক এখনো বহন করেন তিনি। তিনি হয়তো দিন্নাথের মধ্যেই নিজের পুরোনো স্বপ্নকে খুঁজে পান।

এই সিনেমা একসময় ‘বাডি কপ’ থ্রিলারের মতো লাগে, যেখানে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা তরুণ পুলিশ সদস্যকে কঠিন বাস্তবতার তালিম দিচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবতা এতটাই নির্মম যে কোনো প্রস্তুতিই যথেষ্ট নয়। রাত যত গভীর হয়, জটিলতা বাড়তে থাকে। দুজনই তখনো জানেন না, ভয়ংকর এক খেলায় জড়িয়ে পড়বেন তাঁরা, এক দলিত যুবকের মৃত্যু তাঁদের জীবনের গতিপথই বদলে দেবে। দিন্নাথ ও ইওহানন জানতেন না তাঁরা আর রক্ষক নন; বরং সিস্টেমের শিকার হতে যাচ্ছেন। তাঁদের বলির পাঁঠা বানিয়ে বাহবা কুড়াবেন পুলিশের কর্তারা।

‘রন্থ’ সিনেমার পোস্টার। আইএমডিবি

ঊর্ধ্বতন অফিসার তাঁদের একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বলেন। অভিজ্ঞ ইওহানন দৃঢ়, রণকৌশলের মতো বলে ওঠেন, ‘এই খেলাগুলো আমি অনেকবার খেলেছি, আদালতে দেখা হবে।’ কিন্তু তরুণ দিন্নাথ ভেঙে পড়েন, নিজের পরিবার আর অপরাধবোধে। বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তারপরে জানতে পারেন, দুজনকেই আদালতে নেওয়া হবে! অভিযুক্ত ও বিশ্বাসভঙ্গকারী দিন্নাথ তখন ক্লান্ত ট্র্যাজেডির প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন।

দীলেশ পোথান ও রোশন ম্যাথিউ নিজেদের চরিত্রে দুর্দান্ত। দিন্নাথ চরিত্রে রোশনকে দেখে আপনার নিজের অজান্তেই মনে হবে, ‘বেচারা, রাতটা পার করতে পারবে তো!’ আর নির্মাতা ও অভিনেতা দীলেশ যেন এ ছবিতে নিজের সেরা অভিনয়টাই করেছেন। রান্না করা, অসুস্থ স্ত্রীর প্রতি খেয়াল রাখা ও হতাশায় ডুবে থাকা পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে তিনি যথাযথ।

‘রন্থ’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

‘রন্থ’ শাহী কবিরের ‘পুলিশ ইউনিভার্স’–এর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর সিনেমা নয়, কিন্তু তাঁর সবচেয়ে মানবিক সিনেমাগুলোর একটি। এখানে রোমাঞ্চ আছে বটে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি আছে জীবনবোধ, আদর্শ আর বাস্তবতা।

সিনেমার শেষটা যখন আপনাকে নাড়িয়ে দেবে, তখন আপনার মনে হবে, পুলিশের পোশাকের নিচে থাকা মানুষটা হয়তো হারিয়ে যায় রাতের ডিউটি শুরু হওয়ার সময়ই; যখন একটু একটু তাঁর চোখের সামনে এত দিন ধরে রাখা আদর্শ ভেঙে পড়ে।