‘দ্য নিউ ফোর্স’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি
‘দ্য নিউ ফোর্স’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

স্কার্ট পরে পুলিশি দায়িত্ব...

স্কার্ট পরে নারীদের কি পুলিশের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব? তা–ও আবার সুইডেনের মতো শীতপ্রধান দেশে! বাস্তবে এটাই হয়েছিল। সেই ঘটনা নিয়ে নেটফ্লিক্সে গত শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে সুইডিশ সিরিজ ‘দ্য নিউ ফোর্স’। যা তৈরি হয়েছে পঞ্চাশের দশকে সুইডেনে ঘটে যাওয়া সত্যি ঘটনা অবলম্বনে। কী হয়েছিল সেই সময়ে? রোয়িদা সিয়েকেরসাজ পরিচালিত সিরিজটিতেই–বা কি দেখা হয়েছে?

সেই সময়ের স্টকহোম
সিরিজটির পটভূমি ১৯৫৮ সালের স্টকহোম। গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন কয়েকজন নারী, যাঁরা প্রথমবারের মতো পুলিশ যোগ দেওয়ার জন্য স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। এই নারীদের মধ্যে রয়েছেন করিন (ইয়োসেফিন আসপ্লুন্ড) ন্যায়বিচারের প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজ করেন। সিভ (অ্যাগেনস রেজ) উচ্চাভিলাষী, বড় গোয়েন্দা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এ ছাড়া আছেন ইনগ্রিড (মেলিন পারসন) যিনি স্বভাবে অন্তর্মুখী; তাঁর জন্য শিক্ষানবিশ সময়টা পার করাই বড় চ্যালেঞ্জ। সিরিজের চরিত্রগুলো কাল্পনিক, তবে তাঁদের সঙ্গে যা যা ঘটে, সেটা আসলে সেই সময়ের স্কটহোমে সত্যিই ঘটেছিল।

কী আছে সিরিজে
‘দ্য নিউ ফোর্স’ সিরিজে দেখা যায়, এই নারীরা সমাজে সাহসী নারী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি। সাংবাদিকেরা তাঁদের ঠাট্টা করেছেন, সহকর্মীরা হালকাভাবে নিয়েছেন, সাধারণ মানুষ উপেক্ষা করেছেন। যদিও তাঁরা পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নিয়েছেন; রাস্তা পাহারা, গ্রেপ্তার, তদন্ত—সবই করেছেন। তবে তাঁদের পথ ছিল নানা বাধা ও চ্যালেঞ্জে ভরা। তাঁরা যে ইউনিফর্ম পরে কাজ করতেন, তা ছিল এমন যা পরে নড়াচড়া করাই কঠিন ছিল; পুলিশি কাজ তো দূরের কথা।  

‘দ্য নিউ ফোর্স’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

সিরিজটি কেবল পুলিশের পেশাদার চ্যালেঞ্জের গল্প নয়; এটি নারীদের ব্যক্তিগত জীবনের চাপ ও মানসিক লড়াইকেও ফুটিয়ে তোলে। দেখা যায়, পেশাগত জীবনের চাপে কীভাবে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনও প্রভাবিত হচ্ছে। প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ আসে, যখন তাঁরা একটি মৃত যৌনকর্মীর দেহ খুঁজে পান। তদন্ত করতে গিয়ে তাঁরা মুখোমুখি হন, ভয়ংকর এক চ্যালেঞ্জের।

সিরিজের পেছনের গল্প
‘দ্য নিউ ফোর্স’ সিরিজের পেছনের বাস্তব ইতিহাসও বেশ আকর্ষণীয়। ১৯০৮ সালে স্টকহোমে প্রথম নারী পুলিশ সদস্য নিয়োগ পান, যাঁদের বলা হতো ‘পুলিশ সিস্টার’। শুরুতে তাঁদের দায়িত্ব ছিল সীমিত। মূলত নারী ও শিশুদের মামলার তদারক করতেন। এ ছাড়া নারী সন্দেহভাজনদের তল্লাশি, নারী বন্দীদের নজরদারি ছিল তাঁদের প্রধান কাজ। অনেকেই নার্সিং বা সামাজিক কাজে পারদর্শী ছিলেন, ফলে সুইডিশ কর্তৃপক্ষ মনে করত, নারীরা পূর্ণাঙ্গ পুলিশি দায়িত্বের চেয়ে বরং সহায়ক হিসেবেই বেশি কার্যকর হবেন।

‘দ্য নিউ ফোর্স’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

১৯১০ সালে স্টকহোম ছাড়াও সুইডেনের অন্যান্য শহরে নারী পুলিশ সদস্যের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। তবে তখনো তাঁদের ভাবমূর্তি ছিল ‘পুলিশ সিস্টার’, ফলে কেউই তাঁদের সিরিয়াসলি নেয়নি। ১৯৩০ সালে তাঁদের দায়িত্ব সম্প্রসারিত হয়। তাঁরা নারীর বাড়ি তল্লাশি, যৌন অপরাধ মামলার তদন্ত, সাক্ষ্য গ্রহণ এবং নিরাপত্তা নজরদারিতেও অংশ নিতে পারেন। ১৯৪৪ সালে তাঁরা প্রথমবার সরকারি প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে নারীরা প্রথমবার পুলিশ একাডেমিতে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পান।
১৯৫৪ সালে ‘পুলিশ সিস্টার’ খেতাব বাতিল করা হয়; নারীরা পুরুষ সহকর্মীর সঙ্গে সমানভাবে স্বীকৃতি পান। তবে কাজের ক্ষেত্র তখনো অনেকটা সীমিত ছিল। সত্যিকারের বড় পরিবর্তন আসে ১৯৫৭ সালে, যখন নারী পুলিশদের জন্য প্রথমবারের মতো পুলিশ একাডেমিতে পুরুষদের মতো একই শর্তে ভর্তি করা হয়। ১৯৫৮ সালে স্নাতক শেষ করা নারী পুলিশ সদস্যরা প্রথমবার রাস্তায় নিয়মিত প্রহরায় নামেন। ‘দ্য নিউ ফোর্স’-এর গল্প শুরু হয়েছে সেখান থেকেই।

চ্যালেঞ্জ যখন পোশাক
‘পুলিশ সিস্টার’ তকমা তো বাদ গেল, তবে তখনো বড় বাধা ছিল ইউনিফর্ম। তখন নারীরা পুরুষদের মতো পোশাক পরতে পারতেন না। বিশেষভাবে তৈরি ‘স্কার্ট-প্যান্ট’ ডিজাইন করা হয়। কারণ, রাস্তায় শুধু স্কার্ট পরে দায়িত্ব পালন সম্ভব ছিল না। জ্যাকেটের পকেটও সীমিত ছিল, হাতিয়ার ছোট এবং নিরাপত্তা সরঞ্জাম নারীদের শরীরের জন্য উপযোগী ছিল না। নারী পুলিশদের জন্য পুরো-প্যান্ট অনুমোদিত হয় ১৯৭৪ সালে; যা নারীদের কাজের স্বাধীনতা ও সমতার প্রতীক হয়ে ওঠে।

‘দ্য নিউ ফোর্স’ সিরিজটির ইংরেজি নাম। মূল সুইডিশ নাম ‘স্কিফটেট’; এর অর্থ ‘পরিবর্তন’। নারীদের পুলিশ বাহিনীতে প্রবেশ এবং ধীরে ধীরে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার গল্প সিরিজের মূল সুর।

এই সিরিজ শুধু ইতিহাস তুলে ধরে না, বরং দেখায় যে নারী-পুরুষ সমতার পথে কত কঠোর সংগ্রাম করতে হয়। প্রথম নারী পুলিশদের জীবনযাত্রা, তাঁদের দৈনন্দিন বাধা, কাজের চ্যালেঞ্জ এবং সমাজের উপেক্ষার মধ্য দিয়ে তাঁরা কীভাবে ধীরে ধীরে তাঁদের অবস্থান তৈরি করে, তা সিরিজে ফুটে উঠেছে। এখন সুইডেনে পুলিশ বাহিনীতে প্রায় ৩৫ থেকে ৩৮ শতাংশ নারী সদস্য রয়েছেন।

‘দ্য নিউ ফোর্স’–এর দৃশ্য। আইএমডিবি

কী বলছেন সমালোচকেরা
প্রতিদিন নিত্যনতুন কাজের চ্যালেঞ্জ, পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই চ্যালেঞ্জে নামতে হয়। তবে কেউই তাঁদের ‘আসল পুলিশ’ মনে করে না। না সরকার, না সমাজ, না সহকর্মীরা—এমন কঠিন চ্যালেঞ্জ পার করে নারীদের সংগ্রামের গল্প নির্মিত সিরিজটির প্রশংসা করেছেন সমালোচকেরা। এটি একদিকে যেমন নারীদের সাহসিকতার গল্প, তেমনই কঠিন বাধা অতিক্রম করে অন্যদের অনুপ্রাণিত করার গল্পও বটে। সিরিজটিতে শিল্পীদের অভিনয়ের প্রশংসাও করেছেন সমালোচকেরা। এ ছাড়া পঞ্চাশের দশকের স্টকহোমকে যেভাবে বিশ্বাসযোগ্যভাবে পর্দায় হাজির করেছেন নির্মাতা; সেটারও তারিফ করেছেন তাঁরা।

তথ্যসূত্র: টাইম