ওটিটির যুগে ক্রাইম-থ্রিলার আর নতুন কিছু নয়, ফি–সপ্তাহেই মুক্তি পায় এন্তার কনটেন্ট। তবে এর কয়টা মনে রাখার মতো, সেটা হলো কথা। ড্যানিশ সিরিজ ‘ফরবাইডেলসেন’ ক্রাইম-থ্রিলার সিরিজের ‘মিছিল’ শুরুর আগের কাজ। ২০০৬ সালে মুক্তি পাওয়া নর্ডিক সিরিজটি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল সংগত কারণেই। পরে এটির ইংরেজি রিমেকও হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এবার এসেছে ভারতীয় সংস্করণ ‘সার্চ: দ্য নায়না মার্ডার কেস’। মূল কাজটি যখন ভালো আর রিমেকের প্রধান চরিত্রে কঙ্কণা সেনশর্মা; তাই সিরিজ নিয়ে আলাদা আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘নায়না’ কি জমল, নাকি আরও একটি গড়পড়তা সিরিজ হয়েই রইল?
একনজরেসিরিজ: ‘সার্চ: দ্য নায়না মার্ডার কেস’ধরন: ক্রাইম-থ্রিলারস্ট্রিমিং: জিও হটস্টারপরিচালক: রোহান সিপ্পিঅভিনয়: কঙ্কণা সেন শর্মা, সূর্য শর্মা, শিব পণ্ডিত, ধ্রুভ সেহগাল, শ্রদ্ধা দাস
ক্রাইম সিরিজের প্রধান চরিত্র মানেই ব্যক্তিগত জীবনের নানা টানাপোড়েন জর্জরিত কোনো পুলিশ কর্মকর্তা। এখানেও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রথম পর্বেই দেখা যায় প্রধান চরিত্র এসিপি সংযুক্তা দাস (কঙ্কণা সেন শর্মা) শহর ছাড়ার তোড়জোড় করছেন। মুম্বাইয়ে নিজের কর্মস্থলে তাঁর অনেক সুনাম। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় সংসার ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। তাই স্বামী যখন আহমেদাবাদে চাকরি নেন, সংযুক্তা ঠিক করেন পুলিশের সাইবার ক্রাইমে বদলি হয়ে তিনিও স্বামীর কাছে চলে যাবেন।
সম্পর্ক জোড়া লাগানোর আরেকবার চেষ্টা আরকি। কর্মস্থলের শেষ দিনে কেক কেটে তাঁকে বিদায়ও জানানো হয়। কিন্তু মানুষ যা ভাবে তাই হয়! সেদিনই জানা যায়, এক কলেজছাত্রী লাপাত্তা। পরে লাশ পাওয়া যায়, লেকের পানিতে এক গাড়ির ডিকিতে। সেই গাড়ি আবার ব্যবহৃত হচ্ছিল এক রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারে। ব্যস, রাজনৈতিক যোগ; হাই প্রোফাইল কেস; সব মিলিয়ে সংযুক্তার ‘বিদায়’ বিলম্বিত হতে থাকে। সেই পর্যন্ত কী হয়, সেটা জানতে হলে দেখতে হবে ছয় পর্বের সিরিজটি।
তদন্ত শুরুর পরই সংযুক্তার ঝামেলা বাধে সদ্য যোগ দেওয়া সহকর্মী জয়ের (সূর্য শর্মা) সঙ্গে। জয় হলো সেই ধরনের পুলিশ কর্মকর্তা যাঁরা মাথার চেয়ে হাত বেশি ব্যবহার করতে চান। তাঁদের অম্ল-মধুর সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় তদন্ত। একে একে আসতে থাকে সন্দেহভাজনদের নাম। তালিকায় আছেন তুষার (শিব পণ্ডিত)-রাজনৈতিক দলের আকর্ষণীয় নেতা, যিনি নারীর ক্ষমতায়নের অ্যাপ চালু করতে চলেছেন। এ ছাড়া তাঁর নির্বাচনী প্রচারের ম্যানেজার সাহিলও (ধ্রুভ সেহগাল) আছেন তালিকায়। তুষারের সহকারী ও গোপন প্রেমিকা রক্ষাকেও (শ্রদ্ধা দাস) সন্দেহের বাইরে রাখা যায় না। কিন্তু আসল খুনি কে?
‘সার্চ: দ্য নায়না মার্ডার কেস’ সেই ধরনের ক্রাইম ড্রামা, যা একবার দেখা যায়, কিন্তু মনে রাখার মতো নয়। পুরোপুরি ওটিটির ‘নিয়ম মেনে’ তৈরি সিরিজটিতে গভীর ছাপ রাখার মতো কিছু নেই। সিরিজটি কৌতূহল উদ্দীপক, প্রধান চরিত্রে যখন কঙ্কণা, তখন মনোযোগ ধরে রাখতে বাধ্য। তাঁর সঙ্গে নতুন আসা এসিপি জয়ের রসায়নও জমে ওঠে, কিন্তু ক্লিশে চিত্রনাট্যের কারণেই পরের ধাপে পৌঁছাতে পারে না সিরিজটি।
কঙ্কণা সেনশর্মা, সূর্য শর্মা ও শিব পণ্ডিত অভিনয়ের কারণেই সিরিজটি শেষ পর্যন্ত দেখা যায়। তবে তাঁর কঙ্কণার মতো অভিনেত্রীর চরিত্রে আরও ব্যাপ্তি দরকার ছিল। সেটা ছিল না বলেই কঙ্কণা ‘মেয়ার অব ইস্টটাউন’-এর কেট উইন্সলেট হতে পারেননি। পার্শ্ব চরিত্রের অভিনেতারাও চলনসই।
সিরিজের মানবিক দিকগুলো ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন নির্মাতা। কঙ্কণার সঙ্গে তাঁর টিনএজ মেয়ের টানাপোড়েন, সন্তান হারানো নায়নার মা-বাবার আকুতি দেখতে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। কিন্তু এটা তো ড্রামা নয়, ক্রাইম-থ্রিলার। রহস্যের জল ঠিকঠাক বুনতে না পারলে কি আর সিরিজ জমে? সন্দেহ, প্রমাণ আর বিভ্রান্তির অতিরিক্ত ভিড়ে খুনি কে—এই প্রশ্নটাই ততক্ষণে গৌণ হয়ে পড়ে। এমনকি মনে হয়, নায়নার মা–বাবার আরও দুই সন্তান আছে, কিন্তু গল্প সেদিকে তাকানোরও প্রয়োজন বোধ করে না।
নির্মাতা রোহান সিপ্পি নর্ডিক মেজাজে একটি বাণিজ্যিক সিরিজ বানাতে চেয়েছেন, কিন্তু দুইয়ের সমন্বয়টা করতে পারেননি ঠিকঠাক। নাভি মুম্বাইয়ের প্রেক্ষাপটে পুরো সিরিজজুড়েই একটা ধূসর আবহ থাকে, সেটা দেখতে মন্দ লাগে না। নির্মাতা নাভি মুম্বাইয়ের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে গল্পের অঙ্গ করেছেন। বাস্তব লোকেশন ভাসি ব্রিজ, নতুন বিমানবন্দর—সবকিছুই ভিজ্যুয়াল একঘেয়েমি দূর করেছে। ক্যামেরার কাজ বেশ ভালো হলেও আবহসংগীত একেবারেই সাধারণ মানের। এ ধরনের দ্রুতলয়ের ক্রাইম সিরিজের গতি-প্রকৃতি বোঝাতে আবহসংগীত অনেক সময়ই খেই হারিয়েছে। বরং সিরজিটির জন্য আলাদাভাবে আবারও কঙ্কণাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত, তাঁর কারণেই অনেক সাধারণ দৃশ্যও গভীরতা পেয়েছে।
সিরিজের সবচেয়ে হতাশার দিক ক্লাইম্যাক্স। আপনি যখনই ভাববেন এই বুঝি রহস্যের পর্দা উঠবে এবার, ঠিক তখনই কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বড় একটা প্রশ্নবোধক রেখে শেষ হয়ে যায় ‘সার্চ: দ্য নায়না মার্ডার কেস’। পরের কিস্তি আসবেই, কিন্তু প্রথম মৌসুম যাঁরা ছয় পর্ব ধরে দেখলেন, তাঁরা উত্তর তো জানতে পারলেন না।