
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে ১৫ মে মুক্তি পেয়েছে ‘গুলমোহর’। আট পর্বের সিরিজটির পর্বগুলোর নাম ‘সা’, ‘রে’, ‘গা’, ‘মা’, ‘পা’, ‘ধা’, ‘নি’, ‘সা’। পর্বগুলোর নামের মতোই সিরিজটিতে সুরের সংযোগ আছে, কিন্তু তা খুঁজে পেতে অপেক্ষা করতে হয় মাঝপর্যন্ত। তবে নির্মাতা যখন সৈয়দ আহমেদ শাওকী, তখন এ অপেক্ষা যে যথেষ্ট রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘তাকদীর’, ‘কারাগার’-এর মতো আলোচিত থ্রিলার, মিস্ট্রি সিরিজের পর নির্মাতা শাওকী এবার বেছে নিয়েছেন পারিবারিক আবহের গল্প। একটি বাড়িকে কেন্দ্র করে এগিয়ে যায় গুলমোহর। উঠে আসে সম্পর্কের টানাপোড়েন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, নোংরা রাজনীতি আর ক্ষমতার লোভ। শাওকীর সব সিরিজেই এক রহস্যমানব থাকে, তেমন একজন এখানেও আছেন। তাই মাঝখানে একটু গতিমন্থরতায় ভুগলেও পুরো তিন ঘণ্টার সিরিজটি শুরু থেকেই মনোযোগ ধরে রাখে।
একনজরেসিরিজ: ‘গুলমোহর’পর্বসংখ্যা:৮জনরা: ড্রামা, মিস্ট্রিস্ট্রিমিং: চরকিপরিচালক: সৈয়দ আহমেদ শাওকীচিত্রনাট্য: সৈয়দ আহমেদ শাওকী ও মারুফ প্রতীকঅভিনয়: সারা যাকের, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, ইন্তেখাব দিনার, সুষমা সরকার, সারিকা সাবাহ, মোস্তফা মন্ওয়ার, মীর নওফেল আশরাফী জিসানরানটাইম: ২৪-২৬ মিনিট
‘গুলমোহর’ মূলত ভারত সীমান্তঘেঁষা এক কাল্পনিক মফস্সল শহর আয়নারহাটের গল্প। এলাকার চেয়ারম্যান সদ্য মারা গেছেন। কিন্তু তাঁর জানাজায় ঘটে এমন এক ঘটনা, তা নিঃশব্দে বুঝিয়ে দেয়, এলাকায় তিনি কতটা ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। চেয়ারম্যানের চার সন্তান। তাঁর মৃত্যুর পরই সন্তানেরা সম্পত্তি ও ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে শুরু করে।
প্রথমেই ওঠে বাড়ি ভাগের কথা। প্রাসাদসম বাড়ির নাম ‘গুলমোহর’। চেয়ারম্যানের স্ত্রী ও বাড়ির কর্ত্রী গুলবাহার বেগমের নামে এ নাম। কিন্তু বাড়ি বিক্রির কথা যখন এগোতে থাকে, তখনই ঘটে যায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। পায়রার পায়ে বাঁধা অবস্থায় উড়ে আসে মুক্তিপণের চিঠি। কিন্তু কেন চাওয়া হচ্ছে এ মুক্তিপণ? বের হতে থাকে নানা ঘটনা। কেটে যেতে থাকে সম্পর্কের সুর।
পারিবারিক গল্পের মোড়কে দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বার্তা দিতে চেয়েছেন নির্মাতা। বলেছেন ঘরহীন উদ্বাস্তু মানুষের গল্প; সব ছেড়ে একদিন যাদের চলে যেতে হয়েছিল। তবে এসবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে গল্পে যোগ করেছেন শাওকী, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেননি। ‘গুলমোহর’ বাড়ির যমজ দুই নাতির সঙ্গে ছোটবেলায় যা হয়েছিল, সেটা দিয়েও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বার্তা দিয়েছেন। তবে সিরিজটি কেবলই ‘বার্তাবাহক’ নয়; বরং পুরোনো বাড়ি, বাদ্যযন্ত্র, প্রকৃতি আর হারিয়ে যাওয়া মানুষের গল্প। পুরোনো পাপের বোঝা যাদের জীবনভর তাড়া করে।
এমন গল্প নিয়ে বাংলা সিরিজে খুব বেশি কাজ হয়নি, তাই সিরিজটি দেখার সময় বারবারই নতুনত্বের স্বাদ মিলেছে। ‘কারাগার’-এর পর কেন তিন বছরের বিরতি নিয়েছিলেন নির্মাতা, সেটা সিরিজটি দেখলেই বোঝা যাবে। সিরিজজুড়ে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। তবে গুলমোহর ধীরগতির সিরিজ, প্রতি সপ্তাহে যাঁরা ওটিটির টান টান থ্রিলারে অভ্যস্ত, তাঁদের মন্থর লাগতেই পারে। কিন্তু আরেকটি ‘তাকদীর’ বা ‘কারাগার’ না বানিয়ে যে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছেন শাওকী, সে জন্য আলাদা ধন্যবাদ প্রাপ্য তিনি।
সিরিজের প্রথম দৃশ্য থেকেই দর্শকদের আটকে ফেলতে পেরেছেন শাওকী। তবে প্রথম তিন পর্ব দারুণ গতিতে এগোলেও পরে ভাটা পড়ে। একের পর এক সাবপ্লটে গল্পের গতি কিছুটা কমে যায়। অনেক অনেক চরিত্র কিন্তু বেশির ভাগ চরিত্রের প্রতি দর্শকের মায়া জন্মায় না। সাতটি স্বরের মাধ্যমে যেভাবে একটি পরিবারের উত্থান-পতনের গল্প দেখানো হয়েছে, সেটা দারুণ। সম্পর্কের সুর যে ক্ষণে ক্ষণে কেটে যাচ্ছে, তা বেশ ভালোভাবে ফুটে উঠছিল। তবে শেষ দিকে মনে হয়েছে যেন তাড়াহুড়া করে শেষ হয়ে গেল গল্প। গল্পের অনেক মিসিং লিংক জোড়া লেগেছে, কিছু আবার অব্যাখ্যাত রয়ে গেছে। শেষটাও তেমনই, কোথায় কীভাবে শেষ করবেন, সে বিচার যেন দর্শকের ওপরই ছেড়ে দিয়েছেন নির্মাতা।
সিরিজের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছেন মোস্তাফিজুর নূর ইমরান। প্রভাবশালী রানা চরিত্রটি বেশ জটিল; দক্ষতার সঙ্গে তিনি সেটা ফুটিয়ে তুলেছেন। রাজনৈতিক পরিচয়ে এলাকায় প্রভাব বিস্তার হোক কিংবা ছেলেকে হারিয়ে অসহায়ত্ব হোক; তাঁর অভিনয় ছিল বিশ্বাসযোগ্য। ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সময় কাটাচ্ছেন তিনি, গত ছয় মাসে তাঁকে দেখা গেছে ‘রঙিলা কিতাব’, ‘ফেউ’ আর ‘গুলমোহর’-এ। সিরিজ যেমনই হোক, সবখানেই নিজের ছাপ রেখেছেন তিনি।
গুলবাহার বেগমের চরিত্রে সারা যাকের যথাযথ। শান্ত আর দৃঢ়চেতা চরিত্রটি ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সিরিজের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। সিরিজটিতে তাঁর অভিনয়ের ধরন, চরিত্র অভিনেতার জনপ্রিয় কাজগুলোর চেয়ে একেবারেই আলাদা। সিরিজে তাঁর প্রথম উপস্থিতির দৃশ্যটি নির্মাতা যেভাবে দেখিয়েছেন, সেটাও মনে রাখার মতো। ছেলে হারিয়ে যাওয়ার মতো কঠিন সময়ে সারিকা সাবাহর অভিব্যক্তি আরও ভালো হতে পারত। মীর নওফেল আশরাফী জিসান পাগলাটে চরিত্রে মানিয়েছেন ভালো। ওসি তৈমুর আলমের চরিত্রে মোস্তফা মন্ওয়ার চলনসই, তাঁর চরিত্রটির আসলে সেভাবে গভীরতা ছিল না। অন্যান্য চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার, সুষমা সরকার ভালো করেছেন। অভিনয়ের ক্ষেত্রে পুরো নম্বর পাবে শিশুশিল্পীরা। সিরিজের আবহসংগীত আর চিত্রগ্রহণের কথা না বললে আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। রুসলান রেহমান ও বরকত হোসেন পলাশের আবহসংগীত আর ক্যামেরা গল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
শাওকীর সব কাজেই সমাজের প্রান্তিক মানুষের গল্প উঠে আসে। প্রথম সিরিজ ‘তাকদীর’-এ ছিল যৌনকর্মীর গল্প, ‘কারাগার’-এ যুদ্ধশিশু। ‘গুলমোহর’-এও আছে এমন কিছু। সেটা বলে দিলে কি আর গল্পের মজা থাকে!