রাজেশ খান্না ও শর্মিলা ঠাকুরের ‘আবিষ্কার’ সিনেমাটা অনেকেই দেখেছেন। এক দম্পতির এক রাতের কাহিনি। ওই রাতই আবার তাদের বিবাহবার্ষিকী। প্রেম করে বিয়ে করেছিল। এত বছর পর তাদের বড় সমস্যা প্রেমহীনতা। বিয়ের আগে বা বিয়ের পরে সেই যে তুমুল ভালোবাসা, প্রচণ্ড আবেগ—কালক্রমে তা কোথায় হারিয়ে গেল? হারিয়ে ফেলা সেই ভালোবাসা নতুন করে আবিষ্কার করার গল্পই আসলে ‘আবিষ্কার’ সিনেমার কাহিনি। ১৯৭৪ সালের এই সিনেমার জন্য রাজেশ খান্না ফিল্মফেয়ারের সেরা অভিনেতা হয়েছিলেন। রাজেশ খান্না তখন বিপুল জনপ্রিয় সুপারস্টার। তারপরও একেবারেই ভিন্ন ধরনের একটি সিনেমা করার সাহস দেখিয়েছিলেন তিনি।
ইতালির ‘লা নত্তে’ (দা নাইট) সিনেমাটাও এক দম্পতির এক রাতের কাহিনি। ১৯৬১ সালে মুক্তি পেয়েছিল। একজন লেখক জোভান্নি ও তার স্ত্রী লিডিয়ার গল্প। এটাও আরেক দাম্পত্য জীবনের গল্প। পরিচালক ওই এক রাতের নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বলেও দেন তাদের দুজনের সম্পর্কের কিছু দিক। তাদের মধ্যেও ছিল গভীর প্রেম। এখনো কি আছে? লিডিয়া কিন্তু একপর্যায়ে বলেও যে সে আসলে এখন আর জোভান্নিকে ভালোবাসতে পারছে না। কেন পারছে না, গল্প সেটাই।
১৯৬১ নয়, দাম্পত্য জীবনের গল্প যদি ২০২৪ বা ২০২৫-এ এসে বলা হয়, তাহলে কেমন হবে সিনেমাটা। তাহলে এবার গত বছরের তুমুল আলোচিত নিকোল কিডম্যানের ‘বেবি গার্ল’ সিনেমার কথা অল্প করে বলা যেতে পারে। সিনেমাটি অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। ১৯ বছরের দাম্পত্য জীবন রোমি আর জ্যাকবের। রোমি কোনো এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জ্যাকবকে বলেই দেয়, শারীরিকভাবে সে মোটেই সুখী নয়। তার আগে কী হলো আর পরেই–বা কী হলো, তা জানার জন্য সিনেমাটা দেখতে হবে।
আবার ২০২৫ সালে এসে দাম্পত্য জীবনের অন্য গল্পও বলা যায়। তার আগে আবার একটু পেছনে যেতে হয়। গোবিন্দ নিহালনির ‘দৃষ্টি’ সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯০ সালে। ডিম্পল কাপাডিয়া ও শেখর কাপুর ছিলেন সিনেমাটিতে। শেখর কাপুর তখন অভিনয় করলেও মূল পরিচয় ছিল ‘মাসুম’ ও ‘মি. ইন্ডিয়া’র পরিচালক। ‘ব্যান্ডিট কুইন’ বানিয়ে তখনো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নাম করেননি। ‘দৃষ্টি’ আরেক দাম্পত্য জীবনের কাহিনি।
মেরিলিন মনরোর বিখ্যাত সিনেমা ‘সেভেন ইয়ার ইচ’ তো বলেই দিয়েছে যে বিবাহিত পুরুষেরা সাত বছর পর হোঁচট খায়।
মেরিলিন মনরোর বিখ্যাত সিনেমা ‘সেভেন ইয়ার ইচ’ তো বলেই দিয়েছে যে বিবাহিত পুরুষেরা সাত বছর পর হোঁচট খায়। ‘দৃষ্টি’ সিনেমায় নিখিল (শেখর কাপুর) ও সন্ধ্যার (ডিম্পল) অবশ্য আট বছরের বিবাহিত জীবন ছিল। দুজনই কর্মক্ষেত্রে সফল, আপাতসুখী জীবন।
সেই নিখিল একদিন জানাল, সে তার ল্যাবরেটরি সহকারী বৃন্দার প্রেমে পড়েছে এবং তারা বিয়েও করবে। তারপর ঠিকই একদিন সন্ধ্যাকে ছেড়ে চলেও গেল নিখিল। সেই বিয়েও টেকেনি। নিখিলের মনে অপরাধবোধ। সেই সন্ধ্যা যদি একদিন বলে বসে, সে–ও বিবাহিত জীবনে আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছিল, তাহলে নিখিলের প্রতিক্রিয়া কী হবে? পরিচালক নারী-পুরুষের সম্পর্কের নানা জটিলতা, দাম্পত্য জীবনের নানা অলিগলির সন্ধান করেছেন এই সিনেমার মধ্য দিয়ে। এই সিনেমা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল ১৯৯১ সালে। গোবিন্দ নিহালনি প্রখ্যাত সুইডিশ পরিচালক ইঙ্গমার বার্গম্যানের ‘সিনস ফ্রম আ ম্যারেজ’ নামের এক মিনি সিরিজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘দৃষ্টি’ বানিয়েছিলেন।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। মূল প্রসঙ্গের বিষয় ‘এই রাত তোমার আমার’। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় নিজেই নামী অভিনেতা। পরিচালক হিসেবেও বেশ কয়েকটি ভালো সিনেমা বানিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত সম্ভবত তাঁর সেরা কাজ ‘এই রাত তোমার আমার’। নামটি নেওয়া হয়েছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই কালজয়ী গান ‘এই রাত তোমার আমার’ থেকে। ছোটবেলায় গানটি শুনে মনে হয়েছিল, আহা, কী রোমান্টিক একটা গান!
পরমব্রতর সিনেমাটির নাম থেকেই বোঝা যায়, এক রাতেরই কাহিনি। তবে রোমান্টিক কোনো এক রাতের কাহিনি ভাবলে ভুল হবে। আবার রোমান্টিকতা একেবারেই যে নেই, তা–ও বলা যাবে না। আসলে এটি সম্পর্কের জটিলতার গল্প, দাম্পত্য জীবনের সংকট আবার একই সঙ্গে মাধুর্যেরও গল্প।
কল্পনায় ছিল কোনো এক জ্যোৎস্না রাত, নায়ক তাঁর নায়িকাকে পাশে বসিয়ে গাইছেন গানটি। কিন্তু পরে ‘দীপ জ্বেলে যাই’ সিনেমাটা দেখে ভুল ভেঙেছিল।
পরমব্রতর সিনেমাটির নাম থেকেই বোঝা যায়, এক রাতেরই কাহিনি। তবে রোমান্টিক কোনো এক রাতের কাহিনি ভাবলে ভুল হবে। আবার রোমান্টিকতা একেবারেই যে নেই, তা–ও বলা যাবে না। আসলে এটি সম্পর্কের জটিলতার গল্প, দাম্পত্য জীবনের সংকট আবার একই সঙ্গে মাধুর্যেরও গল্প। ভালোবাসার গল্প আবার বন্ধুত্বেরও গল্প। পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা, দায়িত্ব আর সম্মানবোধেরও গল্প।
অমর গুপ্ত ও জয়িতা—দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন তাদের। বার্ধক্যের নানা জটিলতায় দুজনই আক্রান্ত। জয়িতা ক্যানসারে আক্রান্ত, জীবনপ্রদীপ নিবু নিবু। আগেই বলেছি এক রাতের কাহিনি, সেই রাতটি আবার তাঁদের বিবাহবার্ষিকী। অমর গুপ্তই জয়িতাকে দেখেশুনে রাখেন, স্যুপ বানিয়ে দেন, নিয়মিত ওষুধ খাওয়ান। ৮০ বছর বয়সী অমর গুপ্ত নিজেও পুরো সুস্থ নন, কোমর বা পিঠের ব্যথায় কাবু।
ঝড়ের রাতে দুজনের আলাপচারিতা, অতীতের ব্যর্থতা বা সফলতার গল্প ও আক্ষেপ, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, পুরোনো ক্যাসেট প্লেয়ার খুঁজে বের করে গান শোনা, খানিকটা নাচ, বিয়ের রাত বলে হুইস্কির বোতল খুলে বসা, স্বামীর দুর্বল জায়গায় খানিকটা খোঁচাখুঁচি—এসবই বলে দেয়, জীবনের দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাটিয়ে দেওয়ায় তাঁদের মধ্যে একধরনের বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছে। এতটা সময় একসঙ্গে থাকার মূলমন্ত্র তো কেবল বিয়ে করাই যথেষ্ট নয় কিংবা কেবল অভ্যাসও নয়, ভালোবাসার পাশাপাশি বন্ধুত্বটা থাকতে হয়। আর সেটাই আছে দুজনের মধ্যে। যদিও অতীতের একটা গল্পও এখানে আছে। সে গল্পও জটিল হতো পারত। সেই গল্পটুকু যাঁরা সিনেমা দেখবেন, তাঁদের জন্য তোলা থাক।
পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় নিজেই নামী অভিনেতা। পরিচালক হিসেবেও বেশ কয়েকটি ভালো সিনেমা বানিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত সম্ভবত তাঁর সেরা কাজ ‘এই রাত তোমার আমার’।
অভিনয়ের কথা নতুন করে কিছু বলার নেই। কারণ, অমর এখানে অঞ্জন দত্ত আর জয়িতা অপর্ণা সেন। এককথায় দুর্দান্ত অভিনয়। চিত্রনাট্য বা পরিচালনা—সবই তাই, অর্থাৎ দুর্দান্ত। বয়স্কদের নিয়ে সিনেমা মানেই অসুস্থতা, টিকে থাকা, চিকিৎসা, অর্থ, সেবা, অসুস্থ অবস্থায় নানা কর্মকাণ্ডই সাধারণত বেশি দেখানো হয়। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও এত সুন্দরভাবে দুজনের সম্পর্ক দেখানোর মতো ভালো সিনেমা খুব কমই হয়। অতীতের সব গল্প ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত সম্পর্কের নানা দিকই এ সিনেমার মূল কথা। এ কারণেই ‘এই রাত তোমার আমার’ অবশ্যই দেখাটা দরকার।