চলতি বছরের আলোচিত বিভিন্ন ওটিটির কনটেন্টের দৃশ্য। কোলাজ
চলতি বছরের আলোচিত বিভিন্ন ওটিটির কনটেন্টের দৃশ্য। কোলাজ

মোশাররফ, নিশো, জয়া ছিলেন তবু কি জমল ওটিটি

জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিম, জয়া আহসান, আফরান নিশোদের মতো তারকার সিনেমা-সিরিজ এসেছে। তবু ২০২৫ সালে হইচই ফেলে দেওয়ার মতো কাজ ওটিটিতে ছিল না। থ্রিলারের বাইরে ব্যতিক্রমী কিছু করার চেষ্টা অবশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো।

বড় তারকাদের উপস্থিতি
বড় তারকাদের মধ্যে চলতি বছর ওটিটিতে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে মোশাররফ করিমকে। ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’ (হইচই), ‘অন্ধকারের গান’ (বিঞ্জ), ‘মির্জা’ (বঙ্গ), ‘ডিমলাইট’-এ (চরকি) দেখা গেছে অভিনেতাকে। চারটি ওয়েব সিনেমার মধ্যে অমিতাভ রেজা চৌধুরীর বোহেমিয়ান ঘোড়া আর শরাফ আহমেদের ‘ডিমলাইট’ ছাড়া বাকি দুই কাজই গড়পড়তা। মোশাররফ চেষ্টা করেছেন, কিন্তু দুই প্রকল্পের চিত্রনাট্যে দম ছিল না।

জয়া আহসানকে প্রথমবার দেখা গেছে দেশের ওটিটিতে; আশফাক নিপুনের সেই সিরিজ ‘জিম্মি’ অবশ্য তেমন জমেনি। ভিকি জাহেদের ‘নীল সুখ’-এ দেখা গেছে মেহজাবীন চৌধুরীকে। অভিনয় দিয়ে মুগ্ধ করেছেন মেহজাবীন; সিরিজটিও মন্দ ছিল না। রোজার ঈদে ‘হাউ সুইট’-এ গ্ল্যামার গার্ল চরিত্রে হাজির হয়ে চমকে দিয়েছিলেন তাসনিয়া ফারিণ। কাজল আরেফিনের ওয়েব সিনেমাটি উপভোগ্য, অপূর্ব আর ফারিণের রসায়নও জমেছিল বেশ।

ওয়েব ফিল্ম ‘হাউ সুইট’–এ অভিনয় করেছেন অপূর্ব, ফারিণ, পাভেল

বিরতির পর ভিকি জাহেদের ‘আকা’ দিয়ে ওটিটিতে ফেরেন আফরান নিশোও। সিরিজে তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। তবে শুরুটা ভালো হওয়ার পরও সিরিজটি শেষ পর্যন্ত ঠিক জমেনি।

‘জিম্মি’র ট্রেলারে জয়া আহসান। হইচই

দুর্বল প্রত্যাবর্তন
আপাদমস্তক শয়তানি কিন্তু মেজাজে রসিক—এমন একটা চরিত্র অ্যালেন স্বপন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা চরিত্রটিকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন নাসির উদ্দিন খান। তাঁর উপস্থিতি এতটাই প্রবল যে একাই পুরো সিরিজকে টেনে নিয়ে যেতে পারেন তিনি, সে গল্প যা-ই হোক। ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন’-এর প্রথম কিস্তি ছিল দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত একটা কাজ। কিন্তু চলতি বছর চরকিতে মুক্তি পাওয়া ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন ২’ মোটেও জমেনি। এবারও নাসির উদ্দিন আছেন, পর্দায় তাঁর খ্যাপাটে পারফরম্যান্সও আছে, তবে শিহাব শাহীনের সিরিজটির চিত্রনাট্যের গাঁথুনি কোথাও যেন ঢিলে হয়ে গেছে।

একই কথা আশফাক নিপুনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ‘মহানগর’-এর দুই কিস্তি বানিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় থাকা এই নির্মাতার ‘জিম্মি’ গড়পড়তা কাজ। আরও জমাটি হতে পারত চিত্রনাট্য। শুরুর দিকের পর্বগুলো দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন প্রায় কিছুই ঘটছে না, এক জায়গাতেই আটকে আছে। মুশকিলটা হয়েছে, সিরিজের ট্রেলারে গল্পের অনেক কিছুই দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে, দেখার সময় তাই নতুনত্বের স্বাদ মিলছিল না।

‘আমলনামা’র পোস্টার থেকে । কোলাজ

সুমন আনোয়ারকে ইদানীং অভিনয়েই দেখা যায় বেশি; ওয়েব ফিল্ম ‘মির্জা’ দিয়ে নির্মাতা পরিচয়ে ফিরেছেন। কিন্তু এটিও সাধারণ মানের ক্রাইম থ্রিলার; মোশাররফ করিমের অভিনয়ের জন্যই শেষ পর্যন্ত দেখা যায়।

ব্যতিক্রমী চেষ্টা
সারা দুনিয়ার ওটিটির কনটেন্টেই ক্রাইম-থ্রিলারের জয়জয়কার; তবে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছে দেশি প্ল্যাটফর্মগুলো। চরকির ‘ফেউ’ ও ‘গুলমোহর’ ছিল তেমনই চেষ্টা। মরিচঝাঁপি গণহত্যার পটভূমিকায় নির্মিত সুকর্ণ সাহেদের সিরিজ ফেউ ছিল সাহসী কাজ; তবে এর দুই কিস্তি একসঙ্গে মুক্তি পেল ভালো হতো।

প্রথম মৌসুমে গল্প শেষ না হওয়ার অতৃপ্তি থেকে যায়। সম্পর্কের টানাপোড়েন, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, নোংরা রাজনীতি আর ক্ষমতার লোভ নিয়ে সৈয়দ আহমেদ শাওকীর ‘গুলমোহর’ও ব্যতিক্রমী কাজ; সিরিজটির সঙ্গে নির্মাতা যেভাবে সুরের যোগ ঘটিয়েছেন, সেটাও দারুণ। দুই সিরিজেই ব্যতিক্রমী দুই চরিত্রে অভিনয় করে চলতি বছর ওটিটির অন্যতম সেরা অভিনেতা নিঃসন্দেহে মোস্তাফিজুর নূর ইমরান।

‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’য় মোশাররফ করিম। হইচই

থ্রিলারের বাইরে গিয়ে দারুণ কিছু চরিত্র আর কমেডির জাদুতে ‘হাউ সুইট’-এ দর্শকদের পর্দায় আটকে রাখতে পেরেছেন কাজল আরেফিনও। এই ওয়েব সিনেমায় খল চরিত্রগুলোও ছিল ভিন্ন।

ট্রাক ড্রাইভার চরিত্রে মোশাররফ করিম আর তাঁর আট বউয়ের গল্প নিয়ে অভিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘বোহেমিয়ান ঘোড়া’ও ছিল ভিন্নধর্মী কাজ। এই সিরিজ দিয়ে অভিষেকেই চমকে দিয়েছেন আসমা উল হুসনা। এই সিরিজ ছাড়াও ওয়েব ফিল্ম ‘ডিমলাইট’ আর ‘অমীমাংসিত’ দিয়ে চলতি বছর ওটিটির উজ্জ্বল অভিনেত্রী তানজিকা আমিন।
আইস্ক্রিনে মুক্তি পাওয়া অনন্য প্রতীক চৌধুরীর প্রথম নির্মাণ ‘নয়া নোট’ও মোটাদাগে ভালোই হয়েছে। নাসির উদ্দিন খানের অভিনয় আর ব্যতিক্রমী গল্প এই ওয়েব সিনেমার প্রাণ।

এবং রাফী
শুরুতে দুটি আর শেষে দুটি—সব মিলিয়ে ২০২৫ সালে রায়হান রাফীর একটি ওয়েব সিরিজ আর তিনটি ওয়েব সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। ২ জানুয়ারি বঙ্গতে আসে নির্মাতার প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘ব্ল্যাক মানি’। সিরিজটি কেমন হয়েছে, প্রথম আলোর রিভিউয়ের শিরোনামেই তা বলে দেওয়া হয়েছে—‘হরেক রকম মরিচ তবে ঝাল কম’। শুরুটাও যদিও মন্দ ছিল না। পরিচালক বলেছিলেন, এটা ‘ডার্ক কমেডি’। কিন্তু কমেডিই হোক বা অ্যাকশন, বিনোদনের তেমন খোরাক নেই।

‘ব্ল্যাক মানি’তে পূজা চেরী ও চিত্রনায়ক রুবেল

মূল সমস্যা হলো গল্পের দম নেই, চিত্রনাট্যও তথৈবচ। অথচ সিনেমায় যা পারা যায় না, সিরিজে সেটা করা যায়; সেটা হলো চরিত্রগুলো গভীরভাবে নির্মাণ। কিন্তু এ সিরিজে সে চেষ্টাই করেননি নির্মাতা। তবে বছরের শুরুর দিকে আরেক ওয়েব ফিল্ম ‘আমলনামা’য় দেখা যায় চেনা রাফীর ঝলক। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘিরে এটা হতে পারত থ্রিলার, পরতে পরতে রোমাঞ্চের স্বাদ হয়তো আরও বেশি দর্শককে আকৃষ্ট করত। ক্রসফায়ার নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতরের গল্প নিয়ে রুদ্ধশ্বাস ইনভেস্টিগেটিভ সিনেমাও হতে পারত। তবে রায়হান রাফী তুলনামূলক সহজ সেসব পথে না হেঁটে বলতে চেয়েছেন দুই পরিবারের গল্প। আক্রান্ত আর আক্রমণকারীকে জুড়ে দিয়েছে দুই কন্যাশিশু। দীর্ঘদিন পর এ ওয়েব ফিল্ম দিয়েই জাহিদ হাসানের মনে রাখার মতো প্রত্যাবর্তনও হয়।

চলতি ডিসেম্বর মাসে বায়েস্কোপ প্লাস ও আইস্ক্রিনে আসে নির্মাতার আরও দুই ওয়েব ফিল্ম ‘নূর’ ও ‘অমীমাংসিত’। তবে কোনটি দিয়েই ‘আমলনামা’কে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি রাফী। নূর অনেক আগের নির্মাণ, নানা জটিলতায় আটকে ছিল, দেখার পর বেশ খাপছাড়া নির্মাণ মনে হয়েছে। আর আলোচিত সাংবাদিক দম্পতির হত্যাকাণ্ড নিয়ে নির্মিত ‘অমীমাংসিত’ সেন্সর জটিলতা পার করে মুক্তি পেয়েছে। ফ্ল্যাশব্যাকে রাফীর চেনা স্টাইলে নির্মাণ চলনসই কিন্তু দেখার সময় মনে হয়, জটিলতা এড়াতে অনেক দৃশ্য হয়তো সম্পাদনায় বাদ পড়েছে।