
‘পৃথিবীর সবকিছু এখন একহাতে চলে যাচ্ছে। যার জাহাজের ব্যবসা সে–ই ইন্টারনেট চালায়, তার হাতে বড় বড় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম; সিনেমাও সে–ই নিয়ন্ত্রণ করে। সামনে হয়তো আরও খারাপ সময় আসছে, যখন নির্মাতাদের সে গল্পই বলতে হবে, যা তাঁকে বলতে বলা হবে।’ চলতি বছর ধর্মশালা চলচ্চিত্র উৎসবে ভারতীয় গণমাধ্যম মানিকন্ট্রোলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্র বিশেষ করে ওটিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন দিবাকর ব্যানার্জি। দিবাকরের নতুন সিনেমা ‘টিস’ যা নেটফ্লিক্স প্রযোজনা করেছে। কিন্তু ‘অতি সংবেদনশীল রাজনীতিক বিষয়’ থাকায় তিন বছর ধরে মুক্তি দিচ্ছে না। দিবাকর মনে করেন, বড় তারকা আর অ্যালগরিদমের পেছনে ছুটে প্ল্যাটফর্মগুলো কার্যত সিনেমার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকছে।
সিনেমা দুনিয়ার খোঁজখবর রাখলে দিবাকরের এই বক্তব্য কতটা প্রাসঙ্গিক, সেটা এতক্ষণে আপনার বুঝে যাওয়ার কথা। নেটফ্লিক্স ওয়ার্নার ব্রাদার্স কিনে নিচ্ছে—এই খবর আনুষ্ঠিক হওয়ার পর থেকেই বিশ্বজুড়ে চলছে প্রবল বিতর্ক। নেটফ্লিক্স যদি ওয়ার্নার ব্রাদার্স কিনে নেয়, তাহলে কী লাভ? এত সমালোচনাই–বা হচ্ছে কেন? কী আছে বহুল আলোচিত এই চুক্তিতে?
৭২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি
হলিউডে বড়সড় এক ঝড় বইয়ে দিয়ে নেটফ্লিক্স গতকাল ঘোষণা করেছে, তারা ৭২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের ডিসকভারির চলচ্চিত্র ও স্ট্রিমিং ব্যবসা কিনে নিচ্ছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় দাঁড়ায় ৮ লাখ ৪২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। দীর্ঘ প্রতিযোগিতার পর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কমকাস্ট ও প্যারামাউন্ট-স্কাইড্যান্সকে পেছনে ফেলে চূড়ান্ত বিডার হিসেবে এগিয়ে গেছে নেটফ্লিক্স।
স্ট্রিমিং, টেলিভিশন, সিনেমা হল—সব মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী যে নতুন বিনোদন বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে, এই চুক্তি সেই বাস্তবতাকে আরও বদলে দিতে পারে। একদিকে নেটফ্লিক্সের দ্রুত বিস্তার; অন্যদিকে ওয়ার্নার ব্রাদার্সের শতবর্ষের ঐতিহ্য—দুই শক্তি যুক্ত হলে গঠিত হবে এক অভূতপূর্ব সাম্রাজ্য।
কী আছে চুক্তিতে
নেটফ্লিক্স কেবল ওয়ার্নার ব্রাদার্সের স্টুডিওই কিনছে না—এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এইচবিও, এইচবিও ম্যাক্সের মালিকানাধীন বিপুল চলচ্চিত্র-টেলিভিশন লাইব্রেরি। এ তালিকায় রয়েছে ‘গেম অব থ্রোনস’, ‘দ্য সোপরানোস’, ‘হ্যারি পটার’, ‘ফ্রেন্ডস’, ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’, ডিসি ইউনিভার্সের বিশাল সুপারহিরো জগৎ। যে স্টুডিও বিশ্বের ‘ক্যাসাব্লাঙ্কা’, ‘সিটিজেন কেইন’-এর মতো সিনেমা বনিয়ে ছিল, তাদের পুরো ঐতিহ্য এখন নেটফ্লিক্সের ঝুলিতে।
নেটফ্লিক্সের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ওয়ার্নার ব্রাদার্সের যেসব সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল, সেগুলো হলেই মুক্তি পাবে। যে স্টুডিও এখনো সিনেমা হলে মুক্তির ধারাকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে, নেটফ্লিক্স সেই চর্চা ধরে রাখবে।
‘বড় দিন’ বলছে দুই পক্ষ
ওয়ার্নার ব্রাদার্সের প্রধান নির্বাহী ডেভিড জ্যাসলাভ বলেন, ‘এই চুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের দুই সেরা গল্প বলার প্রতিষ্ঠান একজোট হচ্ছে।’ তাঁর ভাষ্য, ‘একসঙ্গে এলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও বিশ্বের সবচেয়ে স্মরণীয় গল্পগুলো উপভোগ করার সুযোগ পাবে।’
চুক্তিটি নগদ অর্থ ও শেয়ারের সমন্বয়ে করা হয়েছে। প্রতি শেয়ারের মূল্য হয়েছে ২৭ দশমিক ৭৫ ডলার। মোট কোম্পানির মূল্য ধরলে (ঋণসহ) তা দাঁড়ায় ৮২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে। আর নগদ ও শেয়ার মিলিয়ে চুক্তির মূল্য ৭২ বিলিয়ন ডলার। দুই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদই সর্বসম্মতভাবে চুক্তি অনুমোদন করেছে।
নেটফ্লিক্সের সহ-নির্বাহী প্রধান টেড সারানডস বলেন, ‘আমাদের মিশন সব সময় ছিল বিনোদন দেওয়া। ওয়ার্নার ব্রাদার্সের অসাধারণ চলচ্চিত্র ও সিরিজের ঐতিহ্যের সঙ্গে আমাদের নিজস্ব কনটেন্টের সঙ্গে যুক্ত হলে আমরা দর্শকদের আরও বেশি কিছু দিতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স গত শতাব্দীর বিনোদনকে সংজ্ঞায়িত করেছে। এবার একসঙ্গে আমরা পরবর্তী শতাব্দীকে সংজ্ঞায়িত করব।’
এইচবিওর আলাদা স্ট্রিমিং পরিষেবা (এইচবিও ম্যাক্স) হিসেবে থাকবে? এমন প্রশ্নের জবাবে নেটফ্লিক্সের সহপ্রধান নির্বাহী গ্রেগ পিটার্স বলেন, ‘এইচবিও ব্র্যান্ডের মূল্য অনেক, কিন্তু এখনই তাঁরা এই পরিষেবা ভোক্তাদের কীভাবে সাজিয়ে দেবেন, তা বলা খুব কঠিন। এ জন্য আরও সময় লাগবে।’
এখনকার হিসাব অনুযায়ী, ১৯০টি দেশে নেটফ্লিক্সের ৩০০ মিলিয়নের বেশি পেইড সাবস্ক্রাইবার রয়েছে।
উদ্বেগ আর আশঙ্কা
নেটফ্লিক্স ওয়ার্নার ব্রাদার্সকে কিনে নিচ্ছে এই খবর প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই বিশ্বব্যাপী শুরু হয়েছে সমালোচনা।
রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা এ সমঝোতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। তাদের অভিযোগ, এই অধিগ্রহণ কর্মী ও ভোক্তা—দুই পক্ষের জন্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম শাখা যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, ‘এই একীভূতকরণ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’ তাদের মতে, এই চুক্তি চাকরি কমাবে, মজুরি কমাবে, কর্মপরিবেশ খারাপ করবে, গ্রাহকদের খরচ বাড়বে ও কনটেন্ট বৈচিত্র্য কমিয়ে দেবে।
সিনেমা ইউনাইটেডের প্রধান নির্বাহী মাইকেল ও’লিয়ারি বলেছেন, এই অধিগ্রহণ বিশ্বজুড়ে সিনেমা ব্যবসার জন্য ‘অভূতপূর্ব হুমকি’ তৈরি করবে। তার দাবি, এর নেতিবাচক প্রভাব বড় সার্কিট থেকে শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছোট শহরের সিঙ্গেল হল পর্যন্ত পৌঁছাবে।
চুক্তিটি ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহল থেকে শিল্প সংগঠন—সবাই উদ্বেগ জানাতে শুরু করে। অভিযোগ—এটি স্ট্রিমিং দুনিয়ায় একচেটিয়া ক্ষমতার জন্ম দিতে পারে। সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনের ভাষায়, ‘নেটফ্লিক্স-ওয়ার্নার ব্রাদার্স মানে বিশাল একচেটিয়া বাজার। সাবস্ক্রিপশন দাম বাড়বে, পছন্দ করার সুযোগ কমবে, আর কর্মীদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে।’
রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা বলছে, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্ট্রিমিং প্রতিষ্ঠান যখন তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে গিলে ফেলে, তখন সেটা বড় আশঙ্কার বিষয়। এটা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।’ ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সাবেক প্রধান নির্বাহী জেসন কিলার বলেন, ‘হলিউডে প্রতিযোগিতা কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ওয়ার্নারকে নেটফ্লিক্সের হাতে তুলে দেওয়া।’
অভিনেতাদের ইউনিয়ন স্যাগ-আফট্রা এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এ ধরনের বড় চুক্তি সৃজনশীল কর্মীদের আয় ও ক্যারিয়ারকে সংকটে ফেলতে পারে। এটি শিল্পে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ক্ষমতা তৈরি করবে।’
সিনেমা হল মালিকরাও আতঙ্কিত। আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী অ্যাসোসিয়েশন সিনেমা ইউনাইটেড বলছে, ‘এটি সিনেমা হলের জন্য অভূতপূর্ব এক হুমকি।’ কারণ, নেটফ্লিক্স অনেক আগে থেকেই সিনেমা হল নিয়ে মাথা ঘামায় না। মুক্তি দিলেও সেটাও খুব সিমীত পরিসরে। ফলে ওয়ার্নারের বড় বাজেটের ব্লকবাস্টারগুলো ভবিষ্যতে সরাসরি স্ট্রিমিংয়ে চলে গেলে সিনেমা হল ব্যবসা বড় ধাক্কা খেতে পারে।
বিবিসি, ভ্যারাইটি ও টাইম অবলম্বনে