‘ব্রিং হার ব্যাক’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি
‘ব্রিং হার ব্যাক’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

এই সিনেমা দেখা কঠিন, ভুলে যাওয়া আরও কঠিন

শুরুতে পূর্বাভাস ছিল, সিনেমায় কী থাকতে পারে। সেটা সত্যি করে পরের দিকে বেশ কয়েকটি অস্বস্তিকর দৃশ্য আছে। এ ধরনের সিনেমায় অভ্যস্ত হয়ে না থাকলে গা গুলিয়ে উঠতে পারে। তবে পর্দায় দেখে যতটা না অস্বস্তি, তার চেয়ে বেশি অস্বস্তি তৈরি হয় নির্মাতাদ্বয়ের তৈরি করা আবহের জন্য। তাই সিনেমাটি দেখা কঠিন বটে, এর চেয়েও কঠিন দেখার পর ভুলে যাওয়া। চলতি বছরের আলোচিত অস্ট্রেলিয়ান হরর সিনেমা ‘ব্রিং হার ব্যাক’ শেষ করার পর তাই পরিতৃপ্তির রেশ থেকে যায় অনেকক্ষণ।
কয়েক বছর ধরেই আলোচিত অস্ট্রেলিয়ান যমজ ভ্রাতৃদ্বয় ড্যানি ও মাইকেল ফিলিপো। ইউটিউবে হরর ভিডিও বানিয়ে দুনিয়াজুড়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন। জিতেছেন বহু পুরস্কার। ২০২৩ সালে তাঁরা সুপারন্যাচারাল হরর সিনেমা ‘টক টু মি’ বানিয়ে চমকে দেন। সানড্যান্স উৎসবে প্রিমিয়ারের পর দুনিয়াজুড়ে হইচই পড়ে যায়। দুই বছরের বিরতির পর এবার তাঁরা হাজির ‘ব্রিং হার ব্যাক’ নিয়ে। এটিও যে হরর সিনেমা, সেটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন।

এক নজরেসিনেমা: ‘ব্রিং হার ব্যাক’ধরন: সুপারন্যাচারাল হররপরিচালনা: ড্যানি ও মাইকেল ফিলিপোঅভিনয়ে : বিলি ব্যারেট, সোরা ওং, স্যালি হকিন্স ও জোনা রেন ফিলিপসস্ট্রিমিং: অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও ও অ্যাপল টিভি প্লাসদৈর্ঘ্য: ১০৪ মিনিট

চলতি বছরের ২৯ মে অস্ট্রেলিয়ায় মুক্তির পরই আলোচনায় আসে সিনেমাটি। পরে এটি যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি দেয় প্রযোজনা সংস্থা এ২৪। আগামী ১ আগস্ট যুক্তরাজ্যে মুক্তি পাবে ‘ব্রিং হার ব্যাক’। ১৫ মিলিয়ন ডলার বাজেটের সিনেমাটি এর মধ্যেই বিশ্বজুড়ে ২৩ মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করেছে, পেয়েছে সমালোচকদের উচ্চ কণ্ঠ প্রশংসাও। কিন্তু কী আছে এত আলোচিত সিনেমাটিতে?

ঘটনাস্থল দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার শহরতলি অ্যাডিলেড। আলো–ছায়া বুঝতে পারলেও আইনগতভাবে অন্ধ পাইপার (সোরা ওং) ও তার বড় ভাই অ্যান্ডি (বিলি ব্যারেট) একদিন বাড়ি ফিরে দেখে, তাদের বাবা বাথরুমে পড়ে আছেন কোনো একধরনের খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়ে। মারা গেছেন অনেকক্ষণ আগেই। দুই ভাই–বোন এতিম হয়। বয়সে প্রায় ১৮ ছোঁয়া অ্যান্ডি ঠিক করে, যত দিন না সে পাইপারের অভিভাবকত্ব আইনিভাবে নিতে পারছে, একসঙ্গেই থাকবে। কিন্তু অ্যান্ডির ১৮ বছর হওয়ার আগপর্যন্ত সরকারি নিয়মে তাদের একজন পালক মা প্রয়োজন। সেই পালক মা লরা (স্যালি হকিন্স)। অভিজ্ঞ শিশু মনোরোগবিশেষজ্ঞ ও সমাজকর্মী। তার বড়, নির্জন বাড়িতে দুই ভাই–বোন হাজির হয়।

‘ব্রিং হার ব্যাক’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

শুরু থেকেই লরা যেন অদ্ভুত রকম আনন্দিত। হাসিমুখ, অতিরিক্ত আদর—যা অদ্ভুত ঠেকে। লরার একটি কন্যা ছিল, অন্ধ। যে রহস্যজনকভাবে মারা গেছে। বোঝা যায়, সে জন্যই হয়তো পাইপারকে নিয়ে অতি উচ্ছ্বসিত। পাইপারকে পেয়ে নিজের মেয়েকে হারানোর কষ্ট ভুলতে চাইছে। লরা ছাড়াও বাড়িতে আছে তার দত্তক নেওয়া সন্তান অলিভার (জোনা রেন ফিলিপস)। কিন্তু এই অলিভারের কী যেন ঝামেলা আছে। নিঃশব্দ, সাদা চোখ, গালের নিচে দাগ আর এক অন্ধকার গহ্বরের মতো দৃষ্টিভঙ্গি। কী চায় সে? বোনকে নিয়ে অ্যান্ডি এ কোথায় এসে হাজির হলো? ধীরে ধীরে খোলাসা হতে থাকে রহস্য।

‘ব্রিং হার ব্যাক’-এর এই ‘হার’ আসলে লরার অকালপ্রয়াত মেয়ে। লরা আসলে মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে চায়। সে স্বাভাবিকভাবে সম্ভব নয়। কিন্তু সে আশ্রয় নেয় তন্ত্রসাধনার। এটা করতে গিয়ে সে কত দূর যেতে পারে, সেটাই দেখানো হয়েছে সিনেমায়। এই হরর ছবির মূল লক্ষ্য কেবল জাম্প স্কেয়ার ব্যবহার করে চমকে দেওয়া নয়; বরং এমন কিছু দেখানো, যা মনকে নাড়া দেয়, গা শিউরে তোলে, স্বপ্নেও ধাওয়া করে। আদতে সিনেমাটি হয়েছেও তেমন; একেবারে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার মতো।

‘ব্রিং হার ব্যাক’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

ছবির শুরুতেই গ্রেনি ভিএইচএস ফুটেজে দেখা যায় তন্ত্রসাধনা। একটি ঝুলন্ত মরদেহ, বিকৃত মুখ, আর তার মাঝখানে দেখা যায় লরাকে। প্রথম দৃশ্যেই পরিষ্কার—লরা কেবল সাধারণ নারী নয়, অন্ধকারের প্রতিনিধি। এরপর যতই গল্প এগোয়, সেই অন্ধকার গ্রাস করে।

লরার নির্মমতা ধীরে ধীরে অ্যান্ডি ও পাইপারের জীবনে বিষ ছড়ায়। অ্যান্ডি প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে নিজেকে প্রস্রাবের ভেজা বিছানায় পায়—এর পেছনে যে লরার হাত আছে, তা স্পষ্ট। অলিভার নিজের দাঁত ভাঙে, নিজেকে আঘাত করে—এ যেন লরার মানসিক নিপীড়নের বহিঃপ্রকাশ। এমনকি একসময় অলিভার নিজের মুখে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। এই দৃশ্য দেখে আপনি ভয় পাবেন না—আপনি গা গুটিয়ে বসে থাকবেন, যেন দুঃস্বপ্ন ঘিরে ধরেছে।

‘ব্রিং হার ব্যাক’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

তবে সিনেমাতে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মেলে না। পাইপার ও অ্যান্ডির বাবার শেষকৃত্যে লরা চুপিচুপি তার মাথা থেকে এক গোছা চুল কেটে নেয়—এটা কি কোনো তান্ত্রিক তাবিজ? ছবিতে এক ফাঁকা সুইমিংপুল, ফ্ল্যাশব্যাক, প্রতীকী খেলনা—সব মিলিয়ে একটা ঘোরলাগা অভিজ্ঞতা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এগুলো কেন, সেটার স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। এ পরিচালকদ্বয় যেন অস্পষ্টতাকেই পছন্দ করেন; পর্দাজুড়ে আধা ভৌতিক এক পরাবাস্তব অভিজ্ঞতা তৈরি করে।

অ্যান্ডি ও পাইপার চরিত্রে বিলি ব্যারেট ও সোরা ওং-এর অভিনয় দাগ কাটে। অ্যান্ডি ও পাইপারের অসহায়তা, তাদের আত্মিক বন্ধন, তাদের নিরাপত্তার খোঁজ—সবকিছুই প্রাণ পায়। সোরা ওং এই ছবিতে প্রথমবার অভিনয় করছেন, নিজের চরিত্রে এতটাই সাবলীল যে তিনি যেন বাস্তব থেকেই উঠে এসেছেন।

‘ব্রিং হার ব্যাক’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

কিন্তু সবকিছুর কেন্দ্রে যিনি, তিনি স্যালি হকিন্স। নিজেকে যেন তিনি নিজেই ছাপিয়ে গেছেন। হকিন্সের অভিনয় মেরুদণ্ডে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেয়। ভয় আর বেদনার মিশ্রণে তৈরি করেছে এক অভাবনীয় চরিত্র; যার ব্যথা, শূন্যতা আর নিঃসঙ্গতা ধীরে ধীরে পরিণত হয় ভয়াল আগ্নেয়গিরিতে।

ফিলিপস অভিনীত অলিভার চরিত্রটি যতই সময় গড়ায়, ততই ভয়াবহ হয়ে ওঠে। তার কিছু কর্মকাণ্ড এমনভাবে উপস্থাপিত হয় যে অভিজ্ঞ হরর দর্শকেরাও চমকে উঠবেন।
ছবির আবহ সংগীত দিয়েছেন করনেল উইলচেক। যাঁর প্রতিটি কম্পোজিশনে যেন ভূতের ছায়া, যেন জাগতিক নয়; এমন এক অশুভ শক্তির উপস্থিতি। চক্রাকৃতির ভিজ্যুয়াল মোটিফ, পুরোনো টেপে বন্দী ভৌতিক রেকর্ডিং দেখতে দেখতে যেন এক বিভীষিকাময় প্রাচীন রীতির জগতে ডুবে যান দর্শক।

শেষ দৃশ্যের সময় আপনার চোখে সেই ফাঁকা পুলটা হয়তো থাকবে না; বরং মাথায় ঘুরবে এমন কিছু ভয়াল দৃশ্য, যা ঝেড়ে ফেলা সহজ হবে না। ‘ব্রিং হার ব্যাক’ কেবলই একটা হরর সিনেমা নয়; বরং একধরনের মানসিক যাত্রা—যা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি জানতেই পারবেন না, আপনি আদৌ ফিরে আসবেন কি না!