ও আলোর পথযাত্রী

সলিল চৌধুরী
সলিল চৌধুরী

সলিল চৌধুরীর সুর করা কোন গানটি জীবনে প্রথম শুনেছিলাম, এখন তা মনে নেই। হয়তো লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘ওগো আর কিছু তো নয়’ বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘গায়ের বধূ’ কিংবা অন্য কোনো গান। রেকর্ড প্লেয়ারে রেকর্ড চাপিয়ে এসব গান শুনেছি। গানের কণ্ঠশিল্পীদের আমরা যত সহজে চিনি, গানের স্রষ্টাদের সেভাবে চিনি না। তাই লতার গান, সন্ধ্যার গান, হেমন্তের গান—এভাবেই গানকে মনে রাখি। কিন্তু ভাবুন তো, কণ্ঠশিল্পীর গলায় এই গান শোনার আগে একটি গান নিয়ে কত চেষ্টা, শ্রম, সময় ও মেধা গীতিকার ও সুরকার ব্যয় করেন, তা কি শ্রোতারা অনুভব করতে পারেন! কোন গান কোন শিল্পীর কণ্ঠে তুলে দেওয়া হবে, তাও কিন্তু নির্ধারণ করেন তাঁরাই! অর্থাৎ এঁদের বিবেচনায় যে গান যাঁর কণ্ঠে মানাবে বলে মনে হয়েছে, আমরা গানগুলো সেই সেই শিল্পীর কণ্ঠেই পেয়েছি! শিল্পী নির্বাচনে সলিল চৌধুরী ছিলেন অনন্য।

স্বর্ণযুগের যে একঝাঁক সংগীত পরিচালকের সৃষ্টি আজও সমস্ত বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় সমুজ্জ্বল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সেরা নিশ্চয়ই সলিল চৌধুরী। তাঁর জন্ম ১৯২২ সালের ১৯ নভেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। আট ভাইবোনের মধ্যে সলিল ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা জ্ঞানেন্দ্রময় চৌধুরী ছিলেন আসামের চা-বাগানের চিকিৎসক। তিনি ছিলেন অন্য ধাতের মানুষ। চা-বাগানের কুলিদের নিয়ে তাঁদের অধিকার বিষয়ে নাটক করতেন। তিনি প্রচণ্ড ব্রিটিশবিরোধী ছিলেন। কথিত আছে, এক ইংরেজ ম্যানেজার একদিন তাঁকে ‘ইউ ডার্টি নিগার’ বলে গাল দিয়েছিলেন। তখন তাঁকে ঘুষি মেরে তাঁর কয়েকটি দাঁত তিনি ভেঙে দেন! তাঁর সংগ্রহে ছিল পশ্চিমা সংগীতের বিশাল ভান্ডার। শিশু সলিল সেগুলো শুনে শুনে তৈরি হয়েছেন। স্কুল শেষে কলকাতায় পড়তে এসে ভর্তি হলেন বঙ্গবাসী কলেজে। স্নাতক পড়াকালে ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। পার্টির সাংস্কৃতিক সংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে (আইপিটিএ) যোগ দিয়ে সক্রিয়ভাবে প্রচুর কাজ করেন। এই সাংস্কৃতিক দল ভারতের প্রত্যন্ত নানা এলাকায় গান গেয়ে মানুষকে সচেতন করার এক বিরল ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিল।

মাত্র ২২ বছর বয়সে সলিল চৌধুরী ‘গাঁয়ের বধূ’র মতো গান লিখে সুর করেন, যা এক বিস্ময়কর ব্যাপার বটে! তাঁর সম্বন্ধে লতা মঙ্গেশকর বলেছিলেন, ‘আমার দেখা অন্যতম সেরা শিক্ষিত কম্পোজার!’ আর শচীন দেববর্মন তো একদিন সলিল চৌধুরীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেই ফেলেছিলেন, ‘দেখো সলিল, আমার ছেলে পঞ্চম (রাহুল দেববর্মন) তো আমার গান শোনে না, ও সারা দিন তোমার গান শোনে।’

সলিল চৌধুরী ৭৫টিরও বেশি হিন্দি সিনেমায় সংগীত পরিচালনা করেন। এ ছাড়া ৪৫টি বাংলা সিনেমা, ২৬টি মালয়ালম সিনেমা ও কিছু তামিল, তেলেগু, কান্নাড়া, গুজরাটি, মারাঠি, অসমিয়া, ওড়িয়া চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন। তাঁর করা সুরগুলো একেবারে অন্য রকম। আমাদের মাথায়ই আসে না, কী করে মাইকেল মধুসূদন দত্তের আত্মবিলাপ-এ এমন অপার্থিব সুর করা যায়! আর দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সে গান যে কী মাত্রা পেয়েছে, তা সংগীতরস আছে—এমন শ্রোতামাত্রই জানেন। এমনি করে বলা যায় সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’, ‘বোধন’, ‘অবাক পৃথিবী’-র কথা, মাইকেলের ‘রেখ মা দাসেরে মনে’, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পালকির গান’, আরও কত!

সলিল চৌধুরী নিজেই একজন অসামান্য কবি ছিলেন, যা আমরা অনেকেই সেভাবে উপলব্ধি করি না! তাঁর নিজের কথা ও সুর করা এমন কয়েকটি কালজয়ী বাংলা গান: ১. ‘গাঁয়ের বধূ’—হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯৪৯), ২. ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’—হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯৫৪), ৩. ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’—হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (১৯৬৯), ৪. ‘যা রে উড়ে যা রে পাখি’—লতা মঙ্গেশকর (১৯৫৯), ৫. ‘না মন লাগে না’—লতা মঙ্গেশকর (১৯৬৯), ৬. ‘ধরণির পথে পথে’—সুবীর সেন (১৯৮০), ৭. ‘আহা ওই আঁকাবাঁকা যে পথ’—শ্যামল মিত্র (১৯৬২), ৮. ‘যদি কিছু আমারে শুধাও’—শ্যামল মিত্র (১৯৬২), ৯. ‘প্রান্তরের গান আমার’—উৎপলা সেন (১৯৫৩), ১০. ঝুনঝুন ময়না নাচো না’—মুকেশ (১৯৬৮)—এমনই অসংখ্য গান আমাদের যুগ যুগ ধরে মাতিয়ে রেখেছে। এসব গানের সঙ্গে তুলনীয় কোনো কিছুই নয়! আজও বাঙালির যেকোনো আন্দোলনে, অধিকারের উচ্চারণে তাঁর সুর করা গান ‘হেই সামালো’, ‘পথে এবার নামো সাথি’, ‘বিচারপতি তোমার বিচার’, ‘ও আলোর পথযাত্রী’-র কোনো বিকল্প নেই।

সলিল চৌধুরী ঠিক কতগুলো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন, তা বলা মুশকিল! একবার রাজ কাপুর তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘ওর হাতে দিলে ও সব যন্ত্র বাজাতে পারে; তবলা থেকে সরোদ, পিয়ানো থেকে পিকোলো!’ গান রচনা, সুর করা ছাড়াও তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, ছবি আঁকতে পারতেন! বাংলাদেশে এমন বহুমাত্রিক প্রতিভা খুব কমই জন্মেছেন। তাঁর স্ত্রী সবিতা চৌধুরীও একজন স্বনামধন্য গায়িকা ছিলেন (এ বছরই তিনি মৃত্যুবরণ করেন)। কন্যা অন্তরা চৌধুরী শিশুশিল্পী হিসেবে ভীষণ জনপ্রিয় ও সুন্দর কিছু ছড়াগান গেয়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এই বিস্ময়কর বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী মানুষটির মহাপ্রয়াণ ঘটে। মৃত্যুদিবসে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি। তথ্যসূত্র: www.salilda.com