কোন দুঃখে চলে গেলেন রেজাউল করিম

রাজশাহী বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন তিনি। তিন বা ছয় মাস অন্তর একটি প্রোগ্রাম পেতেন। বেতারের সম্মানীর কথা তো সবারই জানা। সম্মানী না, সেখানে সবাই সম্মানের জন্যই যান। এই সম্মানের জন্য যে যেখানে ডাকতেন, ছুটে যেতেন রেজাউল করিম।

রেজাউল করিম
রেজাউল করিম

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার দিঘা গ্রামে রেজাউল করিমের বাড়ি। বাবা আয়েজউদ্দিন ছিলেন যাত্রার অভিনেতা। গলায় ছিল অসাধারণ সুর। মা মমতাজ বেগমের গলাতেও ছিল সুর। মায়ের কোলে বসে বাবার কাছে শিশু রেজাউলের গানে হাতেখড়ি। ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারান, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে মারা যান মা-ও। ওই বয়সেই ছোট চার ভাইবোনের অভিভাবক হয়ে ওঠেন রেজাউল। যাত্রার নায়ক বাবা বড় বিলাসী জীবন যাপন করতেন। কোনো সঞ্চয় ছিল না। এ কারণে পথে বসে যান রেজাউলরা। ছোট চার ভাইবোনের হাত ধরে পথে পথে মানুষ হয়েছেন। কিন্তু সুরের সন্ধান যেখানেই পেয়েছেন, ছুটে গেছেন, গলায় তুলে নিয়েছেন গান। আর ভ্যান চালিয়ে নিবারণ করেছেন পেটের খিদে।

রেজাউল করিম

২০১৪ সালের ৫ অক্টোবর প্রথম আলো অনলাইন রেজাউলকে নিয়ে ‘সুর ছাড়া কিছু নেই তাঁর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করে। এতে চারটি গানের ভিডিও ক্লিপও ছিল। গানগুলো শুনে একজন শ্রোতা মন্তব্য করেন, ‘রেজাউল করিম = মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়।’ ওই বছরই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজ আয়োজিত ‘আনসাং স্টার’ অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনে উপস্থাপক মুন্নী সাহা বলেন, রেজাউল করিম রাজশাহীর মান্না দে। এই বছর ৮ আগস্ট দেশের একটি জাতীয় দৈনিক ভ্যান চালানোর ভিডিওচিত্রসহ তাঁকে নিয়ে ‘কণ্ঠে মানবেন্দ্র, জীবন মানবেতর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করে। সেই প্রতিবেদনে তাঁর গাওয়া গান ‘কেন কাঁদে হে পরান, কী বেদনায় কারে কহি’ ফেসবুকে ভাইরাল হয়।

বিয়ের অনুষ্ঠানেও গান গাওয়ার জন্য রেজাউলের ডাক পড়ত। বিয়েবাড়িতে তিন দিন থেকে গান করতেন। কিছু সম্মানী পেতেন। যদিও তার চেয়ে বড় টান ছিল সুরের প্রতি। ১২ আগস্ট নাটোরের লালপুরের কৃষ্ণরামপুর গ্রামে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গান করতে যান। অনুষ্ঠানের এক সহশিল্পীর কাছ থেকে জানা গেল, ১৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে রেজাউল করিম বলেন, শরীর খারাপ করছে। তিনি একটু ঘুমোবেন। তারপর তিনি অনুষ্ঠান থেকে চলে যান। বেলা তিনটার দিকে বিয়েবাড়ির পাশের একটি গাছে তাঁর ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া যায়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে পুলিশ এটাকে আত্মহত্যা বলেই ধারণা করছে। যদিও তাঁর পরিবার, ভক্ত-অনুরাগী ও সেই অনুষ্ঠানের সহশিল্পীরা আত্মহত্যা বলে মানতে পারছেন না। তাঁরা এ বিষয়ে তদন্ত দাবি করছেন।

রেজাউল করিম

৯ আগস্ট এলাকার কয়েকজন শিক্ষক পদ্মায় নৌকাভ্রমণে গিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গ দেন রেজাউল করিম। পদ্মা পার হয়ে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার বাংলাবাজারে চলে যান তাঁরা। সেদিন ভরদুপুর বৃষ্টি ছিল। বাংলাবাজারের একটি দোকানে বসে খালি গলায় একের পর এক গান গেয়ে শিক্ষকদের মাতিয়ে রাখেন রেজাউল করিম। ফেরার সময় উৎপল কুমার নামের এক শিক্ষক আবিষ্কার করেন শিল্পীর এক পাটি স্যান্ডেল ছেঁড়া। নতুন এক জোড়া স্যান্ডেল কেনার জন্য তাঁর হাতে ৪০০ টাকা গুঁজে দেন উৎপল কুমার। সেই স্যান্ডেল আর কেনা হয়নি। রেজাউল করিমের দাফন অনুষ্ঠানে সেদিনের গল্প বলতে বলতে ডুকরে কেঁদে ওঠেন ওই দিনের সফরসঙ্গী শিক্ষক জালাল উদ্দিন।

শিল্পীর এই রহস্যজনক মৃত্যুর খবরের সঙ্গে স্থানীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর গাওয়া গানগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমির সংস্কৃতিবিষয়ক কর্মকর্তার আসাদ সরকারের কাছে পাওয়া গেল রেজাউল করিমের কণ্ঠে ধারণ করা সর্বশেষ গানটি...‘নয়ন ভরা জল গো তোমার আঁচল ভরা ফুল।’ মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ঢঙে গানটি করেছেন তিনি। ফুলই তিনি নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর করুণ সমাপ্তি দেখে মনে হচ্ছে অশ্রু তাঁকে পিছু ছাড়েনি।