জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও লিওন রাসেলের সঙ্গে রিঙ্গো স্টার
জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান ও লিওন রাসেলের সঙ্গে রিঙ্গো স্টার

স্পেনের সিনেমার সেট ছেড়ে ম্যাডিসন স্কয়ার, রিঙ্গোর হৃদয় কাঁদছিল বাংলাদেশের জন্য

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ইতিহাস গড়ে ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। এটি শুধু আড়াই লাখ ডলারের ত্রাণ তহবিল সংগ্রহে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা ও দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ চিত্র প্রথমবারের মতো পশ্চিমা দুনিয়ার সামনে জোরালোভাবে তুলে ধরে। সেই সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার বিষয়েও সচেতনতা ছড়ায়, শুরু হয় বিশ্বজুড়ে প্রবল সমালোচনা।

এই উদ্যোগের সূত্রপাত হয় সেতারের কিংবদন্তি পণ্ডিত রবিশঙ্করের মাধ্যমে। বাংলাদেশের মানবিক সংকট দেখে তিনি সংগীতের মাধ্যমে কিছু করার কথা ভাবেন। এরপর তিনি যান লন্ডনের শহরতলির ফ্রাইয়ার পার্ক ম্যানসনে, দেখা করেন তাঁর বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে। রবিশঙ্করের কাছে বাংলাদেশের অবস্থা শুনে হ্যারিসন আবেগে আপ্লুত হন। রবিশঙ্করের পরিকল্পনা ছিল একটি ছোট পরিসরের কনসার্ট, কিন্তু হ্যারিসনের মাথায় ছিল অনেক বড় কিছু।
জর্জ হ্যারিসনের ডাকে সাড়া দিয়ে এদিন মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, লিওন রাসেল, জিম কেল্টনার, রিঙ্গো স্টারসহ একঝাঁক কিংবদন্তি শিল্পী।

ড্রামস বাজাচ্ছেন রিঙ্গো স্টার

রিঙ্গো স্টার সেই সময় স্পেনে ‘ব্লাইন্ডম্যান’ নামের একটি চলচ্চিত্রের শুটিং করছিলেন। শুটিংয়ের মাঝপথে জর্জ হ্যারিসনের নিমন্ত্রণ পেয়ে তিনি সবকিছু ছেড়ে চলে আসেন নিউইয়র্কে। মঞ্চে পরিবেশন করেন তাঁর জনপ্রিয় গান ‘ইট ডোন্ট কাম ইজি’, আর বাজান জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে ‘হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস’-এ।
রিঙ্গোর পারফরম্যান্স নিয়ে অনেকেই বলেন, তিনি যেন সেদিন পূর্ণ মনোযোগ ও আবেগ দিয়ে বাজিয়েছেন। এই কনসার্টে রিঙ্গোর জন্য আরেকটি বড় অভিজ্ঞতা ছিল ড্রামার জিম কেল্টনারের সঙ্গে যুগল ড্রাম বাজানো। এটি ছিল তাঁর জীবনে প্রথমবার অন্য একজন ড্রামারের সঙ্গে বাজানোর অভিজ্ঞতা। পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকারে রিঙ্গো জানান, এই অভিজ্ঞতা এতটাই উপভোগ্য ছিল যে তিনি পরবর্তী সময়েও অনেক সময় একাধিক ড্রামার নিয়ে বাজাতে আগ্রহী ছিলেন।

এই কনসার্ট আয়োজনের পথে ছিল নানা অনিশ্চয়তা। বব ডিলান তখন লাইভ পারফরম্যান্স থেকে দূরে ছিলেন, দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন অংশগ্রহণ নিয়ে। অন্যদিকে এরিক ক্ল্যাপটন তখন হেরোইন আসক্তি থেকে সেরে উঠছিলেন। শেষ মুহূর্তে, ৩১ জুলাই রাতে, কনসার্টের চূড়ান্ত মহড়ায় তাঁরা দুজনেই হাজির হন। পরে এক সাক্ষাৎকারে হ্যারিসন জানান, তিনি নিজেও নার্ভাস ছিলেন, কারণ বিটলস ছাড়ার পর এটিই ছিল তাঁর প্রথম টিকিট কনসার্ট।
নিউইয়র্ক টাইমসের শেষ পাতায় এক ছোট্ট বিজ্ঞাপন দিয়ে কনসার্টের প্রচার করা হয়। মুহূর্তের মধ্যে সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। একই দিনে দুপুর ও সন্ধ্যায় দুটি শোর আয়োজন করতে হয়।
আরও বড় চমক ছিল—দর্শকেরা জানতেন না কারা পারফর্ম করবেন। শো শুরুর আগপর্যন্ত পুরো লাইনআপ গোপন রাখা হয়। ফলে যখন একে একে মঞ্চে আসতে থাকেন ডিলান, ক্ল্যাপটন, রিঙ্গো, প্রেস্টন—দর্শকদের উচ্ছ্বাসে যেন স্টেডিয়াম কেঁপে ওঠে।

ড্রামস বাজাচ্ছেন রিঙ্গো স্টার

প্রথম শো শুরু হয় রবিশঙ্কর, আলী আকবর খান ও ওস্তাদ আল্লারাখার শাস্ত্রীয় সংগীত দিয়ে। এরপর পর্যায়ক্রমে হাজির হন জর্জ হ্যারিসন ও তাঁর সংগীতসাথিরা।
কনসার্ট শেষে ডিলান এতটাই আনন্দিত ছিলেন যে হ্যারিসন পরে বলেন, ‘সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল—ঈশ্বর! যদি তিনটা শো করতে পারতাম!’ রবিশঙ্কর পরবর্তী সময়ে বলেন, ‘যা ঘটেছিল তা এখন ইতিহাস। এটা ছিল শতাব্দীর অন্যতম আবেগঘন সংগীত অভিজ্ঞতা।’
‘রোলিং স্টোন’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা ইয়ান ওয়েনার ২০০৫ সালে বলেছিলেন, ‘১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কে বিটলস আসার পর এমন উন্মাদনা আর দেখা যায়নি।’
দুপুর ও সন্ধ্যার দুটি শো মিলিয়ে কনসার্টটি হয়ে যায় সংগীত ও মানবিকতার এক মহান মিলনমেলা। যদিও শুরুর দিকে সংগৃহীত অর্থ নানা আইনি জটিলতায় আটকে যায়, শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সেই অর্থ পৌঁছায় বাংলাদেশের শরণার্থীদের কাছে।
এই কনসার্টের সাফল্য থেকে তৈরি হয় একটি লাইভ অ্যালবাম, তথ্যচিত্রসহ আরও অনেক কিছু। যা কনসার্ট ফর বাংলাদেশকে বিশ্বসংগীতের ইতিহাসে প্রথম ‘তারকাখচিত চ্যারিটি কনসার্ট’ হিসেবে জায়গা দিয়েছে।