বাংলাদেশের সংগীতের ইতিহাসে এক অনন্য নাম এন্ড্রু কিশোর। পেশাদার জীবনে তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন ১৫ হাজারেরও বেশি গানে—এর মধ্যে অসংখ্য গান আজও কালজয়ী। এ জন্য শ্রোতারা ভালোবেসে তাঁকে ডেকেছেন ‘প্লেব্যাক–সম্রাট’ বলে। চলচ্চিত্রের গানে এন্ড্রু কিশোরের অন্যতম সহশিল্পী ছিলেন জনপ্রিয় গায়িকা কনকচাঁপা। তাঁরা জুটি বেঁধে উপহার দিয়েছেন অগণিত জনপ্রিয় গান। আজ মঙ্গলবার, কিংবদন্তি শিল্পীর জন্মদিনে ফেসবুকে এক আবেগমাখা পোস্টে তাঁকে স্মরণ করেছেন কনকচাঁপা।
কনকচাঁপা লিখেছেন, ‘শুভ জন্মদিন, হে তরল সোনা মাখানো কণ্ঠের রাজা এন্ড্রু কিশোর দাদা! আমরা গর্বিত, আমাদের এন্ড্রু কিশোর আছেন! আছেন বলছি, কারণ তিনি এখনো আমাদের জীবনের অংশ—আরও বেশি আপন ও প্রয়োজনীয়।’ ফেসবুক পোস্টে কনকচাঁপা আরও লেখেন, ‘একজন এন্ড্রু কিশোর—একটি কণ্ঠ, একটি গলিত সোনার নদী। সিনেমা হলে তাঁর গান বাজলেই পুরো হল ভরে যেত আবেগে। তাঁর কণ্ঠে ছিল জাদু—যা মানুষকে ভাসাতে, কাঁদাতে, ভালোবাসতে শেখাত। যখন গাইতেন “ডাক দিয়াছে দয়াল আমারে”, তখন মনে হতো—এই পৃথিবীর প্রতি আমাদের অভিমান যেন একসঙ্গে ঝরে পড়ছে। আর যখন গাইতেন “তুমি আমার জীবন”, তখন প্রতিটি মানুষ ভাবত, এভাবেই তো প্রিয়াকে বলতে চেয়েছি আমি!’
কনকচাঁপা জানান, এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে ৩৪ বছর ধরে গান গেয়েছেন। গান গাইবার সময়টা মনে করে লিখেছেন, ‘তিনি (এন্ড্রু কিশোর) আজ নেই, অথচ তাঁর কণ্ঠের প্রতি আমার বিস্ময় কাটে না। মঞ্চে যখন গাই, শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে যাই—ভাবি, কত সম্মান যে আল্লাহ আমাকে বিনা কারণে দিয়েছেন!’
জন্মদিনের দিনে কনকচাঁপা ফেসবুকে পোস্ট করেছেন মতিন রহমান পরিচালিত সালমান শাহ–শাবনূর অভিনীত ‘তোমাকে চাই’ সিনেমার জনপ্রিয় গান ‘আমার নাকেরই ফুল বলেরে তুমি যে আমার’–এর রেকর্ডিং সময়ের একটি স্থিরচিত্র। ছবির ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, ‘এই ছবিটি “তোমাকে চাই” সিনেমার গানের রেকর্ডিংয়ে, সিম্ফনি স্টুডিওতে। এন্ড্রু কিশোর–কনকচাঁপা নামের জুটি যে মহাশিল্পী নিজের ভালোবাসার তুলিতে এঁকেছেন, সেই জাতশিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাইকেও শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁরা দুজনেই আজ আমাদের মাঝে নেই—তবু তাঁদের সুরে, তাঁদের ভালোবাসায় আমরা এখনো বেঁচে আছি।’
১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ। তাঁর মা ছিলেন সংগীতানুরাগী ও কিংবদন্তি কিশোর কুমারের ভক্ত। তাই ছেলের নাম রাখেন ‘কিশোর’। মায়ের সেই ভালোবাসা থেকেই সংগীতে তাঁর পথচলা। ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রে গান শুরু করেন এন্ড্রু কিশোর। তবে জনপ্রিয়তা পান ১৯৭৯ সালের ‘প্রতিজ্ঞা’ ছবির ‘এক চোর যায় চলে’ গানটির মাধ্যমে। এর পর থেকে শুরু হয় ইতিহাস। তাঁর গাওয়া অগণিত কালজয়ী গানের মধ্যে রয়েছে, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘পৃথিবীর যত সুখ আমি তোমার ছোঁয়াতে খুঁজে পেয়েছি’, ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, ‘তুমি আমার কত চেনা’, ‘ও সাথিরে’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘তুমি চাঁদের জোছনা নও’ ইত্যাদি।
২০২০ সালের ৬ জুলাই এন্ড্রু কিশোর পরপারে পাড়ি জমান। কিন্তু তাঁর কণ্ঠ, তাঁর গান এখনো জীবন্ত—শ্রোতাদের হৃদয়ে, স্মৃতিতে, আবেগে। শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে তিনি আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার এবং মেরিল–প্রথম আলো পুরস্কারসহ বহু সম্মান অর্জন করেন।