প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ ‘চর্যাপদ’কে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে গত ৪ থেকে ২৯ আগস্ট ইউরোপের পাঁচটি দেশে নানা কর্মসূচিতে অংশ নিলেন সৃজনী তানিয়া ও সাইমন জাকারিয়া। হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, জার্মানি ও ফ্রান্সে ১০টির বেশি আসরে আদিভাষায় রাগাশ্রয়ী সুরে চর্যাপদের বিভিন্ন কবির রচিত কয়েকটি পদ গান আকারে পরিবেশন করেন সৃজনী তানিয়া। আসরগুলোতে চর্যাপদগুলোর বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন বিভিন্ন দেশের গবেষক-পণ্ডিত। হাঙ্গেরির টেলিভিশন ও অস্ট্রিয়ার রেডিওতেও প্রচারিত হয়েছে সৃজনীর গাওয়া চর্যাগান।
হাঙ্গেরি
গত ৫ থেকে ১৫ আগস্ট হাঙ্গেরির গিওর শহরের সিজনি ইস্তেভান ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত হয় ‘মিডিল বেঙ্গলি রিডিং রিট্রিট কাম ওয়ার্কশপ’। কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলেন ১১টি দেশের ১৬ জন গবেষক, অধ্যাপক, পণ্ডিত। তাঁদের মধ্যে সৃজনী তানিয়াও ছিলেন। তিনি নিজের করা সুরে চর্যাপদের কবি বীণাপা রচিত ‘সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী’ এবং মল্লারী রাগে একতারা, বায়া ও ঘুঙুর বাদ্য সহযোগে ভাদেপার ‘এত কাল হাঁউ অচ্ছিলেঁ স্বমোহেঁ’ পদগুলো পরিবেশন করেন।
১২ আগস্ট হাঙ্গেরির টিভি চ্যানেল তানিয়ার পরিবেশিত কুক্কুরীপা রচিত ‘দুলি দুহি পিটা ধরণ ন জাই’ শীর্ষক পদটি ধারণ করে।
সমাপনী অনুষ্ঠানে কম্বলাম্বরপা রচিত ‘সোনে ভরিতী করুণা নাবী’ পদটির হাঙ্গেরীয় অনুবাদ উপস্থাপন করেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইমরে বংঘা। পরে সৃজনী তানিয়া নিজের করা সুরে একতারা, বায়া ও ঘুঙুর সহযোগে দোহাটির সাংগীতিক রূপ পরিবেশন করেন।
অস্ট্রিয়া
চর্যাপদ পরিবেশনের জন্য ১৫ থেকে ২১ আগস্ট অস্ট্রিয়ার লিনজ শহরে ছিলেন তানিয়া ও সাইমন। লিনজের শান্ত পাহাড়ের বুকে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ স্তূপের পাদদেশে বসে তানিয়া তাড়কপা রচিত ‘অপনে নাহিঁ মো কাহেরি শঙ্কা’ শীর্ষক পদটি পরিবেশন করেন।
অস্ট্রিয়ায় আনুষ্ঠানিক চর্যাপদ আসর অনুষ্ঠিত হয় ১৮ আগস্ট। এদিন রেডিও এফআরওতে প্রচারের জন্য দানিয়ুব নদীর তীরে ধারণ করা হয় একটি অনুষ্ঠান। এ আয়োজনে ছিলেন অস্ট্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন কবি, চলচ্চিত্রকার ও সাংবাদিক-লেখক। অনুষ্ঠানে ভূমিকা বক্তব্য দেন বাংলা একাডেমির উপপরিচালক সাইমন জাকারিয়া। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন অস্ট্রিয়ার কবি ওয়ালি রে। সৃজনী তানিয়ার প্রতিটি গানের পর জার্মান ভাষায় একটি করে নিজের লেখা কবিতা পাঠ করেন ওয়ালি।
চেক প্রজাতন্ত্র
২১-২৩ আগস্ট চেক রিপাবলিকের প্রাগে ভ্রমণ করেন। সেখানে তাঁরা চেক রিপাবলিকের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গবেষক জিনদ্রা স্টলকোভা ও ক্রিস্টিনা হাইমারের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এরপর ঘরোয়া পরিবেশে চর্যাপদের একটি গান পরিবেশন করেন তানিয়া।
জার্মানি
জার্মান সংস্থা এনইটিজেড বাংলাদেশের আমন্ত্রণে চর্যাপদ ও বাউলগান পরিবেশনের জন্য ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট জার্মানির গিসেন ভ্রমণ করেন সৃজনী তানিয়া ও সাইমন জাকারিয়া। ২৪ আগস্ট চর্যাপদ পুনর্জাগরণের আসর আয়োজন করে এনইটিজেড বাংলাদেশ।
প্রথম পর্বে সৃজনী তানিয়া লুইপা রচিত ‘কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল’, কুক্কুরীপা রচিত ‘দুলি জুহি পিটা ধরণ ন জাই’, কৃষ্ণাচার্যপা রচিত (শাহ আলম দেওয়ানের সুরে সমকালীন বাংলায় সাইমন জাকারিয়ার রূপান্তরিত) ‘দৃঢ় করে নাড়ি শক্তি ধ্যানে পেয়ে গেছে’, ভাদেপা রচিত ‘এত কাল হাঁউ অচ্ছিলেঁ স্বমোহেঁ’, বীণাপা রচিত ‘সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী’ পরিবেশন করেন। গানগুলোর ইতিহাস ও তত্ত্বগত দিক নিয়ে আলোচনা করেন সাইমন জাকারিয়া।
দ্বিতীয় পর্বে সৃজনী তানিয়া নিজের ব্যাখ্যাসহ লালন সাঁইয়ের ‘গুরুর দয়া যারে হয়’, ‘সবে বলে লালন ফকির হিন্দু কি যবন’ এবং খোদাবক্স সাঁই রচিত ‘শুভ সাধুসঙ্গ’ ও ‘এসো মা আনন্দময়ী’ গানগুলো পরিবেশন করেন।
দুটি পর্বেই সাইমন–তানিয়ার আলোচনা উপস্থিত দর্শক–শ্রোতার কাছে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন ড. ম্যাক্স স্টিলে।
ফ্রান্স
সৃজনী তানিয়া ও সাইমন জাকারিয়া এরপর যান ফ্রান্সে। ২৭ আগস্ট প্যারিসের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ফ্রান্স কৃতি’র আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় চর্যাপদ পুনর্জাগরণ আসর। সূচনা বক্তব্য দেন গবেষক, অনুবাদক জেরেমি কদ্রন। চর্যাপদের গান পরিবেশন করেন সৃজনী তানিয়া। গানগুলোর ইতিহাস ও তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন সাইমন জাকারিয়া। সাইমন বলেন, ‘চর্যাপদ নিয়ে গবেষণা করতে ১৯২৫ সালে এই প্যারিসে এসেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। ঠিক তার ১০০ বছর পর প্যারিসের মাটিতে আজ চর্যাপদের গানের পুনর্জাগরণের আসর হচ্ছে।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে সৃজনী তানিয়া বাংলার আদি বাদ্য ডমরু ও শঙ্খ বাজিয়ে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে তানিয়ার পরিবেশনার ফাঁকে ফাঁকে বাংলা ভাষায় গানের ব্যাখ্যা ও প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন সাইমন জাকারিয়া। তাঁর আলোচনা ফরাসিতে উপস্থাপন করেন জেরেমি কদ্রন। অনুষ্ঠানে উপস্থিতি ছিলেন বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন এহসানুল হক, ফরাসি অধ্যাপক ড. ফিলিপ বেনুয়া, আলাওল-বিশেষজ্ঞ ড. থিবো দুবের, অবারভিলিয়ে শহরের ভাষা ও সভ্যতাবিষয়ক সম্মানিত সভাপতি কার্লোস সমেডো প্রমুখ।
হাঙ্গেরির সিজনি ইস্তেভান ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রিয়ার রেডিও এফআরও, জার্মানির এনইটিজেড বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের ফ্রান্স কৃর্তির আমন্ত্রণে এই সফর করেন তানিয়া–সাইমন।
সৃজনী তানিয়া এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সিটির সংগীত বিভাগে চর্যাগানের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। জাপান, নেপাল ও ভারতে চর্যাপদের গান পরিবেশন করেছেন।