মঞ্চে মহীনের ঘোড়াগুলি
মঞ্চে মহীনের ঘোড়াগুলি

বাপীদা একটি গাছের নাম: মহীনের ঘোড়াগুলির আদি ঘোড়া স্মরণে

‘ভালোবাসি জ্যোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে’, ‘এই সুরে বহুদূরে’, ‘সুধীজন শোনো’, ‘ভেসে আসে কলকাতা’, ‘সংবিগ্ন পাখিকূল’—এই গানগুলো আমরা অনেকেই শুনেছি। সত্তরের দশকে গাওয়া কলকাতার বিখ্যাত ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির এই গানগুলো এখনো মুখে মুখে ফেরে। ওপরের সব কটি গানের কণ্ঠ, সুরে কিংবা কথায় মিশে আছে একজনের নাম—তিনি তাপস বাপী দাস। মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এই সদস্য বছরখানেক ফুসফুস ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে আজ ভারতীয় সময় সকাল সাড়ে নয়টায় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

মহীনের ঘোড়াগুলির ব্যান্ডের নালহীন এই আদি ঘোড়া ‘বাপীদা’ নামে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। সেমাবার এ লেখা যখন লিখছি (রাত ৮টা), তখন তিনি অন্তিম যাত্রায়। কলকাতার বেহালার বাড়ি থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গড়িয়া শ্মশানে, সেখানেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে এই কিংবদন্তি শিল্পীর। শেষযাত্রায় তাঁর সঙ্গে হেঁটে হেঁটে গান গেয়ে চলেছেন শত শত ভক্ত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জড়ো হওয়া ভক্তদের এই জমায়েতের উদ্দেশ্য, তাঁদের প্রিয় বাপীদাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গানমিছিল করতে করতে শেষবিদায় জানানো। বাপীদার ইচ্ছাই ছিল রঙিন এক শেষযাত্রার, যেখানে সবাই গান গেয়ে তাঁকে বিদায় জানাবেন। আর তাই গড়িয়া শ্মশানের দিকে এমনভাবে যাত্রার আয়োজন, এই শ্মশানেই ১৯৯৯ সালের ২০ জুন শেষকৃত্য হয়েছিল মহীনের ঘোড়াগুলির দলনেতা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের। ২৪ বছর পর আবার সেই জুন মাসেই জীবনাবসান হলো গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের প্রিয় সাগরেদের।

তাপস বাপী দাসের জন্ম ১৯৫৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতায়। তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটা বাংলাদেশে। একবার বাংলাদেশে গাইতে আসার ইচ্ছা ছিল তাঁর। তিনি বাংলাদেশের প্রতি সব সময় আলাদা টান অনুভব করতেন। আমার সঙ্গে যখনই কথা হতো, জানাতেন বাংলাদেশে গাইত আসাসহ আরও কিছু উদ্যোগের কথা। আমরা কয়েকজন মিলে বাংলাদেশে আয়োজনও করতে চেয়েছিলাম, এ বছরই সেটি হওয়ার কথা ছিল। প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছিলাম একসঙ্গে বসে। কিন্তু তার আগেই শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ল। এরপর বছরখানেকের এই কষ্টকর শারীরিক-মানসিক-আর্থিক এই লড়াই, যার পরিসমাপ্তি ঘটল রোববার।

তাপস বাপী দাস

ছোটবেলা থেকেই গানবাজনা ও লেখালেখির প্রতি ঝোঁক ছিল বাপীদার। গানে বাঁধাধরা কোনো তালিম পাননি কখনো। কিশোর বয়সেই বেহালায় পাড়ার অনুষ্ঠানে নিয়মিত গান করতেন। সত্তরের দশকের শুরুতে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। পাড়ার বয়স্কদের ভাষায়, গৌতম চট্টোপাধ্যায় তখন অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের রীতিমতো বখে যাওয়ার তালিম দিচ্ছেন। তখনো মহীনের ঘোড়াগুলির জন্ম হয়নি। তাঁরা সবাই একসঙ্গে আড্ডা দিতেন, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের গান শুনতেন। দলবলসহ কলকাতার রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন নতুন গানের সন্ধানে। রক, লাতিন মিউজিক থেকে শুরু করে বেদে, বৃহন্নলাদের গান, লোকাল ট্রেনের বাউল গান, গ্রামগঞ্জের বাউল উৎসবের গান—সবই মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। পাশ্চাত্যের সঙ্গে বাংলার নিজস্বতা জারি রেখে গান তৈরি করার চেষ্টা করতেন।

তখনকার সময়ে শ্রোতারা রোমান্টিক সুরেলা ঘরানার গানে মোহগ্রস্ত ছিলেন। এসব দেখে গৌতম চট্টোপাধ্যায়, তাপস বাপী দাসরা চিন্তা করতেন, সবকিছু তো আজীবন একই সরলরেখা বরাবর চলতে পারে না। সুতরাং তাঁদের নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হবে।

এরপর নকশাল আন্দোলন শুরু হলে গৌতম চট্টোপাধ্যায় সেই আন্দোলনে যোগ দিলেন। বাপীদা পরোক্ষভাবে নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হয়ে গেলেন। গৌতম চট্টোপাধ্যায় যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে, তখন বাপীদা দূত হিসেবেও গেছেন নকশাল ডেরায়, সেখান থেকে ফেরার পথেই জন্ম ‘হায় ভালোবাসি’ নামে জনপ্রিয় গানের। এরপর একসময় গৌতম চট্টোপাধ্যায় ধরা পড়লেন। ভাগ্য ভালো বিধায় জেল হলো দেড় বছরের। এরপর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতার বাইরে কিছুকাল কাটিয়ে ফিরে এসে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ পেরিয়ে সাতজন সদস্য নিয়ে ১৯৭৫ সালে গঠিত হয় কলকাতার প্রথম ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির।

তাপস বাপী দাস

১৯৭৫-৮১ পর্যন্ত সক্রিয় থাকাকালে ৩টি অ্যালবাম বের হয়েছিল এই ব্যান্ডের। গানসংখ্যা ৮। অ্যালবামের অধিকাংশ গানেই কোনো না কোনোভাবে ছিল বাপীদার উপস্থিতি। গতানুগনিক সংগীতবোধের বাইরে গিয়ে সে সময় তাঁদের গানে রাজনীতি-বিপ্লব, ভালোবাসা, দারিদ্র্য, অন্যায়-অবিচার, স্বাধীনতা—সবকিছুই এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। এরপর এই ব্যান্ড ভেঙে যায়। থেমে যায় কলকাতায় এই ঘোড়াদের খুরের আওয়াজ। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আবার তারা ফিরে আসে তাদের সম্পাদিত অ্যালবাম নিয়ে। মূলত সেই সময়েই মহীনের ঘোড়াগুলি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে মহীন–অধ্যায়ের।
এরপরও যেন শেষ হয়েও হয় না শেষ। তাপস বাপী দাস থেমে থাকেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন নিরলস কাজ করে যাওয়ায়।

মহীনের ঘোড়াগুলি যতটা না ব্যান্ড, তার চেয়েও বেশি করে এটি একটি আন্দোলনের নাম, দর্শনের নাম। যারা নতুন দিনের বাংলা গানের সূচনা করেছিল সেই সত্তরের কলকাতায়। এই আন্দোলনের অন্যতম অগ্রগণ্য যোদ্ধা তাপস বাপী দাস তাদের সেই সাংগীতিক দর্শনকে বুকে ধারণ করে ২০০৩ সালে নতুনদের নিয়ে গঠন করেছিলেন ব্যান্ড ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’। মৃত্যুর আগপর্যন্ত ছিলেন এই ব্যান্ডের দলনেতা। অ্যালবাম প্রকাশের পাশাপাশি নিয়মিত কনসার্টেও দেখা গেছে তাঁদের।
তাপস বাপী দাসের এই সংগ্রাম শুধু গান নিয়ে নয়, রাজনীতি-জীবনবোধ নিয়ে। তাঁর সঙ্গে আলাপের সময় সব সময় রাজনীতি, বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলতেন। কোথায় কোন ধরনের গান হচ্ছে, সেসবের খোঁজ নিয়মিত রাখতেন। বয়স কখনো তাঁকে কাবু করতে পারেনি। তিনি সব সময়ই সক্রিয় থেকেছেন তাঁর গান দিয়ে, লেখা দিয়ে। সব সময় নতুনদের আলো দেখিয়েছেন নতুন কিছু করার, তাদের পাশে থেকেছেন বটগাছ হয়ে, ঠিক যেমনটা ছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

কখনো কোনো কিছুতেই কেউ তাঁকে আপস করতে দেখেননি। তাপস বাপী দাস ও সুতপা ঘোষ দম্পতি থেকেছেন বেহালার পৈতৃক ছোট একটি বাড়িতে। যেই বাড়িতে গেলে সব সময় দেখা মিলত শিষ্যদের, যাঁরা কিনা এসেছেন তাঁদের প্রিয় বাপীদার কাছে। ক্যানসার ধরা পড়ার প্রথম দিকে জমানো টাকা দিয়ে ব্যয়বহুল এই চিকিৎসার খরচ চলেছে। এরপর কিছুদিন পার হলে অর্থাভাবে চিকিৎসা বাধার সম্মুখীন হয়। এরপরও তাঁরা কাউকে জানতে দেননি আর্থিক সমস্যার কথা। হাসিমুখে ফিরিয়ে দিয়েছেন একের পর এক রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক সাহায্য। এরপর জানাজানি হলে কলকাতার সংগীতশিল্পীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখতে শুরু করেন, তহবিল সংগ্রহ করতে শুরু করেন বিভিন্নভাবে। শিল্পীরা কনসার্টের আয়োজন করেও অর্থ সংগ্রহ করেছেন।

একপর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার তাঁর চিকিৎসার সব দায়িত্ব নেয়। তখনো এই দম্পতির দুজনেরই স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, এটা যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা হয়, তবেই তাঁরা রাজি। ব্যক্তিগত কাজে আমি সেই সময় কলকাতায় অবস্থান করছিলাম, এসব ঘটনা ঘটেছে আমার চোখের সামনে। বাপীদার আপসহীন এই মনোভাবের জন্য বারবার আমার মাথা মনের অজান্তেই নত হয়ে এসেছে তাঁর সামনে।

মঞ্চে তাপস বাপী দাস

প্রবল মনোবল ছিল তাঁর। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও প্রচণ্ড খারাপ শারীরিক অবস্থাতেও ভাবতেন, তিনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন, আবার গান গাইবেন, এমনকি বাংলাদেশেও গান গাইতে যাবেন। এই তো কয়েক মাস আগেও চিকিৎসা চলাকালেই নাকে রাইস টিউব লাগিয়ে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের মঞ্চে গান গাইতে হাজির হয়েছিলেন হাজারো মানুষের সামনে। মঞ্চে তিনি তাঁর ব্যান্ড ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’ নিয়ে পরিবেশন করছিলেন শ্রোতৃপ্রিয় গানগুলো। কোনো কিছুই থামাতে পারেনি সত্তরের কলকাতায় ‘নতুন দিনের গান’ আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা এই তাপস বাপী দাসকে। তিনি দৈহিকভাবে চলে গেছেন কিন্তু আজীবন থেকে যাবেন ভক্তদের হৃদয়ে।