‘বাংলাদেশে গান করতে ভীষণ ভালো লাগে, এখানকার শ্রোতা এত ভালো। বাংলাদেশের সংস্কৃতি এত ভালো।’ ২০১৪ সালে ঢাকায় শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসবে এসে বলেছিলেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী রশিদ খান। তিন দশকের ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকবার শীতের ঢাকায় গান করেছেন রশিদ খান। তাঁর দরদভরা কণ্ঠের মায়াজালে বহু রাত বুঁদ থেকেছেন শ্রোতারা। চিরতরে স্তব্ধ হলো তাঁর সেই কণ্ঠ, থেমে গেল সুর।
দিল্লি, কলকাতা, ঢাকা ছাপিয়ে বিশ্বজুড়ে রশিদ খানের অনুরাগী ছড়িয়ে আছে। প্রস্টেট ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েও সংগীত নিয়ে দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন তিনি। মাসখানেক ধরে শারীরিক জটিলতা নিয়ে কলকাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অনুরাগীরা ভেবেছিলেন হাসপাতাল থেকে ফিরে আবারও বেরিয়ে পড়বেন তিনি। কিন্তু তিনি আর ফিরলেন না।
‘আয়ো গে জব তুম…’ বলে ডাকলেও আর চোখ মেলবেন না রশিদ খান। গতকাল মঙ্গলবার তিনি কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চিরবিদায় নিয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।
রশিদ খান রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার শিল্পী ছিলেন। এই ঘরানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইনায়েত হুসেন খান। এর বৈশিষ্ট্য হলো মধ্যম নিচু লয়, মুক্ত কণ্ঠ ও জটিল তাল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেওয়াজ করতে হতো তাঁকে। ‘বিলম্বিত খেয়াল’ পরিবেশনের জন্য বেশ খ্যাতি ছিল রশিদ খানের। তারানাতেও তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল।
১৯৬৮ সালের ১ জুলাই উত্তর প্রদেশের বদায়ুঁতে জন্ম রশিদ খানের। ওস্তাদ নিসার হুসাইন খানের কাছে প্রাথমিক তালিম নেন তিনি। ১০ বছর বয়সে কলকাতায় চলে আসেন রশিদ। মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রথম মঞ্চে ওঠেন তিনি। শৈশবেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অনুপ্রাণিত হন তিনি। তাঁর মধ্যে ওস্তাদ আমির খান ও পণ্ডিত ভীমসেন যোশী, গুরু ওস্তাদ নিসার হুসাইনের প্রভাব রয়েছে। পণ্ডিত ভীমসেন যোশী একবার বলেছিলেন, ‘রশিদ খানের কণ্ঠ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ভবিষ্যৎ।’
শাস্ত্রীয় সংগীতের বাইরে বলিউড ও ভারতীয় বাংলা সিনেমার গানেও পাওয়া গেছে রশিদ খানকে। বলিউডের ‘মাই নেম ইজ খান’, ‘যব উই মিট’, ‘ইশক’; কলকাতার সিনেমা ‘বাপি বাড়ি যা’, ‘কাদম্বরী’, ‘মিতিন মাসি’সহ বেশ কয়েকটি সিনেমার গান করেছেন তিনি।
রবীন্দ্রসংগীতও গেয়েছেন রশিদ খান। ২০০০ সালের দিকে ‘বৈঠকি রবি’ অ্যালবামে গান রয়েছে তাঁর। রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে রশিদ খান বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, রবীন্দ্রসংগীত না গাইলে কোনো শিল্পীর জীবনে পূর্ণতা আসে না।’
২০০৬ সালে ‘পদ্মশ্রী’ পুরস্কার পান রশিদ খান। ২০২২ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘পদ্মভূষণ’–এ ভূষিত হন তিনি।
রশিদ খানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘ভাবিনি কোনো দিন রশিদের মৃত্যুসংবাদ এভাবে দেব। ওর কী বয়স।’ পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ, সংগীতশিল্পী সনু নিগম, নির্মাতা অরিন্দম শীলসহ আরও অনেকে শোক জানিয়েছেন।
আজ বুধবার রশিদ খানের মরদেহ কলকাতার রবীন্দ্রসদনে নেওয়া হবে। এরপর নাকতলার বাড়িতে নেওয়ার পর টালিগঞ্জে সমাহিত করা হবে।