
আবেগ, সুর, বিদ্রোহ, প্রেম—সবকিছুর মিশেল ছিলেন আসামের সমকালীন জনপ্রিয় গায়ক জুবিন গার্গ। তাঁর কণ্ঠে যেমন ছিল আঞ্চলিকতার মাটির গন্ধ, তেমনি ছিল আধুনিকতাও। আসামের ভক্তদের মতে, ভূপেন হাজারিকার পর আসামের সংস্কৃতিকে নতুন পথ দেখানো শিল্পী জুবিন।
ভক্তদের কাছে তিনি শুধু গায়ক ছিলেন না, ছিলেন আবেগ, ছিলেন এক যুগের প্রতীক। অসংখ্য বিতর্ক সত্ত্বেও তাঁর কণ্ঠের মায়া, সৃষ্টিশীলতা আর মানবিকতার জন্য তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতের গানের জগতে জনপ্রিয় নাম। মাত্র ৫২ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরে স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারালেন এই জনপ্রিয় গায়ক। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে স্তম্ভিত গোটা আসাম, বিস্মিত ভারতের সংগীতপ্রেমীরা।
সিঙ্গাপুরে স্কুবা ডাইভিং করতে গিয়ে মৃগীরোগে আক্রান্ত গায়কের মর্মান্তিক মৃত্যু ভক্তদের জন্য বড় আঘাত। জুবিন গার্গের জীবনে তিন দশকের বেশি সময়জুড়ে থাকা গানের ঝংকার হঠাৎ করেই স্তব্ধ হলো। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর থেকে আলোচনায় উঠে এসেছে এক প্রশ্ন—যিনি দীর্ঘদিন ধরে মৃগীরোগে ভুগছিলেন, তিনি কেন এত ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চারে গেলেন? তাঁকে কি কেউ থামাতে পারত না?
জানা গেছে, বছর তিনেক আগে ডিব্রুগড়ের এক রিসোর্টে শৌচাগারে পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান জুবিন। সে সময় চিকিৎসকেরা স্পষ্টই বলেছিলেন, তাঁর মৃগীরোগ আছে এবং সে কারণেই তিনি পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন। মাথার গুরুতর চোট থেকে সুস্থ হলেও সেই থেকে তাঁর শারীরিক দুর্বলতা বেড়েছিল। মঞ্চে গান গাইতে গিয়ে বহুবার গলা কেঁপে উঠত, শ্বাসকষ্ট দেখা দিত। তবু তিনি থামেননি, ভক্তদের জন্য গান গেয়ে গেছেন।
কিন্তু এ অবস্থায় স্কুবা ডাইভিংয়ের মতো ঝুঁকিপূর্ণ খেলায় অংশ নেওয়াটা কতটা নিরাপদ ছিল? চিকিৎসক, পরিবার, নাকি বন্ধু—কেউ কি তাঁকে এ ব্যাপারে নিরস্ত করেছিল? নাকি শিল্পীর নিজের জেদই তাঁকে ঠেলে দিয়েছে এ সিদ্ধান্তে?
সেই শেষ ডুব
সিঙ্গাপুরের সমুদ্রতটে ডাইভিং করতে গিয়েই ঘটে দুর্ঘটনা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎই জুবিন অচেতন হয়ে ভেসে ওঠেন। উদ্ধারকর্মীরা দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও আর বাঁচানো যায়নি। মাথায় আবারও গুরুতর আঘাত পান তিনি, যা আগের চোটের জায়গার সঙ্গেই মিলে যায়। শিল্পীর মৃত্যুর পর চিকিৎসক মহলেও আলোচনা শুরু হয়েছে। মৃগীরোগে আক্রান্ত কেউ যদি পানির নিচে যায়, হঠাৎ খিঁচুনি হলে তার জীবন রক্ষা প্রায় অসম্ভব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জুবিন হয়তো এই ঝুঁকি সম্পর্কে জানতেন, কিন্তু শিল্পীসুলভ অ্যাডভেঞ্চারপ্রবণতা তাঁকে এ সিদ্ধান্তে ঠেলে দিয়েছিল।
ভক্তদের মনে তাই এখন শোকের সঙ্গে ক্ষোভও কাজ করছে। ‘জুবিনদা তো আমাদের প্রাণ। তিনি জানতেন তাঁর অসুখ আছে, তবু কেন গেলেন ডাইভিংয়ে’—গুয়াহাটির এক তরুণ ভক্তের ক্ষোভ মিশ্রিত কান্নার সুরে ভেসে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই লিখছেন, একজন পাবলিক ফিগার হিসেবে তাঁকে আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল। আবার অনেকে বলছেন, জুবিন ছিলেন স্বভাবতই বিদ্রোহী, তিনি বাঁধাধরা নিয়ম মানতে চাইতেন না।
বহুমুখী প্রতিভার অকাল বিদায়
কেবল গায়ক নন, জুবিন ছিলেন সংগীত পরিচালক, অভিনেতা, প্রযোজক, লেখক। অহমিয়া, বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি—সব ভাষাতেই গেয়েছেন তিনি। ৪০ হাজারের বেশি গান তাঁর কণ্ঠে রেকর্ড হয়েছে। তাঁর হাত ধরে আসামের আঞ্চলিক গান পৌঁছে গেছে সর্বভারতীয় মঞ্চে। তাঁকে বলা হতো ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের রকস্টার’। ভূপেন হাজারিকার পর আসামের সংস্কৃতিকে যিনি বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছিলেন, তিনি জুবিন গার্গ। তাই তাঁর মৃত্যু কেবল একজন শিল্পীর মৃত্যু নয়, বরং এক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বড় ক্ষতি।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জুবিন স্বপ্ন বুনছিলেন। তাঁর প্রযোজিত নতুন ছবি রই রই বিনালে মুক্তির অপেক্ষায় ছিল ৩১ অক্টোবর। সেটি আর দেখা হলো না তাঁর। ভক্তদের কণ্ঠে এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস, ‘এত তাড়াতাড়ি কেন চলে গেলেন আমাদের জুবিন?’ তাঁর এই অকালপ্রয়াণ তাই ভক্তদের মনে এক দ্বন্দ্ব তৈরি করেছে। তিনি কি নিজের রোগকে উপেক্ষা করে অতিরিক্ত সাহসী হয়ে উঠেছিলেন? নাকি জীবনকে সম্পূর্ণ উপভোগ করতে চেয়েছিলেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত?