
জিমি হেনড্রিক্স, কার্ট কোবেইন, অ্যামি ওয়াইনহাউসদের সঙ্গে তুলনায় থাকেন তিনি—বাংলা সংগীতের ক্ষণজন্মা তারকা হ্যাপী আখান্দ্। ২৭ বছর বয়সে বিদায় নিলেও তাঁর গানের সুর আজও বয়ে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। আজ তার জন্মদিন।
রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছিল ঠিকঠাক, অথচ কারও মনে ছিল না উচ্ছ্বাস। ১৯৮৭ সালের শীতের এক সন্ধ্যায় হঠাৎ থেমে যায় এক সুরের জীবন। মাত্র ২৭ বছর বয়সে শেষ হয় হ্যাপী আখান্দে্র সংগীতের ভ্রমণ।
‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ গানের শুরুটা যেমন সৌন্দর্যে ভরা, তেমনি বিষণ্নও। বাংলা গানের ইতিহাসে এমন কিছু সুর আছে, যেগুলো একবার শুনলেই হৃদয়ে থেমে থাকে, কণ্ঠে লেগে যায়, সময়ের সঙ্গে মিশে অমর হয়ে যায়। ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ তেমনই এক গান। প্রজন্ম পেরিয়ে প্রজন্ম গেয়ে চলেছে। গানের মালিক কে, তা অনেকেই জানে না, কিন্তু সুরের মায়া কার হাতে জন্ম নিয়েছিল, সেই নাম আমাদের সংগীতজগতের অমূল্য সম্পদ—হ্যাপী আখান্দ্।
জিমি হেনড্রিক্স, কার্ট কোবেইন, ব্রায়ান জোন্স, জ্যানিস জপলিন, অমর সিং চমকিলাসহ ৭০ জনের বেশি সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী ও কবির মতোই হ্যাপী ছিলেন এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা। তাঁরা অপার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন মাত্র ২৭ বছরে। এই গোষ্ঠীকে বলা হয় কিংবদন্তি ‘ক্লাব টোয়েন্টি সেভেন’। চাইলেই এই ক্লাবের সদস্য হওয়া যায় না; সেখানে পৌঁছাতে হয় মৃত্যুতে। হ্যাপী আখান্দ্ও যেন এই ক্লাবের এক অলিখিত সদস্য। উইকিপিডিয়ার তালিকায় তাঁর নাম নেই, কিন্তু শ্রোতাদের হৃদয়ের খাতায় তিনি অমর—বাংলা সংগীতের এক চিরসবুজ দীর্ঘশ্বাস।
পাতলা খান লেনের মিউজিক্যাল পরিবার
আজ ১২ অক্টোবর হ্যাপী আখান্দে্র জন্মদিন। আজ বেঁচে থাকলে ৬৫ পূর্ণ করতেন। ১৯৬০ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার পাতলা খান লেনের আখান্দ্ পরিবারে জন্ম তাঁর। কেতাবি নাম জিয়া হাসান আখান্দ্। তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন পারসি, পদবি ছিল ‘আখান্দ্জাদে’। সংগীত তাঁদের ঘরে যেন বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার। বড় ভাই লাকী আখান্দ্ ছিলেন তাঁর শিক্ষক, বন্ধু ও পথপ্রদর্শক। হ্যাপীর জন্মের পরই লাকী তাঁর হাতে এক পয়সা গুঁজে দেন। কয়েক দিন পর হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় সেই পয়সাটিই তাঁর মুঠোয় পাওয়া গিয়েছিল। যেন সুরের উত্তরাধিকার প্রতীকীভাবে হস্তান্তরিত হয় সেদিনই!
পুরোনো কাগজেও হ্যাপী আখান্দে্র তেমন কোনো সাক্ষাৎকার বা তাঁকে নিয়ে লেখা পাওয়া যায় না। যেটুকু তথ্য, তা লাকী আখান্দে্র সঙ্গে কথা বলেই জানা যায়। নিজের শেষ সময়ে আরমানিটোলার বাসায় অসুস্থ অবস্থায় দেয়ালে টাঙানো ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে আদরের ছোট ভাইটির স্মৃতিচারণা করেন অগ্রজ। সেদিন তাঁর চোখে দেখেছিলাম হ্যাপীকে, তাঁর মুখে শুনেছিলাম হ্যাপীকে। বড় ভাই লাকী আখান্দে্র সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মার সম্পর্ক। জীবনকালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপচারিতায় লাকী আখান্দ্ বলেন, ‘বাবার কাছ থেকে যা জেনেছি, হ্যাপীকে শিখিয়েছি। হ্যাপীকে আমি অনেক দুঃখ দিয়েছি। তখন আমাদের অনেক অভাব ছিল, দুঃখ–যন্ত্রণা ছিল। তবে সংসারে যদি অভাব না থাকত, আমাদের ভেতরে যদি কষ্ট না থাকত, তাহলে আমাদের ভেতরে মিউজিক ঢুকত না।’
হ্যাপীর ১০ বছরের বড় ছিলেন লাকী আখান্দ্। হ্যাপীর গানের হাতেখড়ি হয় শৈশবে, আট বছর বয়সে। এক স্মৃতিচারণায় লাকী আখান্দ্ বলেন, ‘আমরা দুই ভাই একসঙ্গে অনেক গান করেছি। আমার সঙ্গে বাজাত হ্যাপী। ১৯৬৮ সালে বাদ্যযন্ত্রের দোকান বুদ্ধু অ্যান্ড কোংয়ের বুদ্ধুদাকে দিয়ে ২৫০ টাকা দামের একটা স্প্যানিশ গিটার বানালাম। দুই ভাই মিলে সেই গিটার নিয়ে কত গান যে করলাম!’ আরেক দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লাকী আখান্দ্ বলেন, ‘১৯৭৫ সালে কলকাতায় এক বাসায় মান্না দের দেখা পেয়ে গেলাম। সঙ্গে ছিল হ্যাপীর গাওয়া “আবার এল যে সন্ধ্যা”র রেকর্ড। বাজিয়ে শোনালাম। মুগ্ধতা নিয়ে মান্না দে বলেন, “কে গাইছে?” বললাম, হ্যাপী, আমার ছোট ভাই। মান্না দে বলেন, “দারুণ গায়, চমৎকার থ্রোয়িং!” শোনা যায়, রাহুল দেববর্মনও একবার হ্যাপী আখান্দে্র প্রশংসা করেন।’
মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালের পর জাতীয় দিবসগুলোয় গণসংগীতে গাইতেন হ্যাপী। পৃথিবীর নানা ধাঁচের সংগীত শুনে শুনে ও দেশ–বিদেশের বিভিন্ন গুণী শিল্পীর সান্নিধ্যে এসে নিজের মতো করে চর্চা করতেন তিনি।
জীবনকালে তাঁকে নিয়ে এক স্মৃতিচারণায় মাইলসের শাফিন আহমেদ বলেন, ‘বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে যেকোনো একটা হাতে তুলে দিলেই হ্যাপী আখান্দ্ সেখান থেকে মিউজিক্যাল কিছু বের করে আনতেন। সব বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে পারতেন। এমনকি বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও সক্রিয় বা সরব থাকতেন।
শাফিন আহমেদের স্মৃতিতে
জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন হ্যাপী আখান্দ্। জীবনকালে তাঁকে নিয়ে এক স্মৃতিচারণায় মাইলসের শাফিন আহমেদ বলেন, ‘বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে যেকোনো একটা হাতে তুলে দিলেই হ্যাপী আখান্দ্ সেখান থেকে মিউজিক্যাল কিছু বের করে আনতেন। সব বাদ্যযন্ত্রই বাজাতে পারতেন। এমনকি বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও সক্রিয় বা সরব থাকতেন। সব সময় দেখেছি, হ্যাপী গানের ভেতর ঢোকার উপায় পেয়ে যেতেন। এমনও সময় ছিল, ঘরে চার থেকে পাঁচজন আড্ডা দিচ্ছি। হয়তো সবার জন্য অ্যাকুয়াস্টিক গিটার নেই। হাতের কাছে কিছু না পেয়ে পকেট থেকে ম্যাচের কাঠি বের করে সেটা দিয়েই কিছু একটা বাজাতেন হ্যাপী। প্রখর মিউজিক সেন্স ছিল। কোনো গানে যদি কঠিন কোনো নোট থাকত, সবার আগে হ্যাপীর কানে বাজত। কোনো নোট মিস করতেন না। অন্যরা হয়তো খুঁজছে নোট, কিন্তু হ্যাপী ঠিকই বের করে ফেলেছেন। তাঁর জীবনে মিউজিক ছাড়া আর কিছু ছিল না।’
বন্ধুরা আমাকে বাঁচিয়ে রেখো
হ্যাপীর গানগুলোর মধ্যে ‘কে বাঁশি বাজায় রে’, ‘নীল নীল শাড়ি পরে’, ‘আমি আবার আসব ফিরে’, ‘চল যাই চলে দূরে বহু দূরে’, ‘সবাই যখন ঘুমে’সহ আরও বেশ কিছু গান। ১৯৭৩ সালে বড় ভাই লাকী আখান্দে্র সঙ্গে একটি ব্যান্ড গড়েন হ্যাপী। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ব্যান্ডটি ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর হ্যাপীর নামে ব্যান্ডের নামকরণ করেছিলেন ‘হ্যাপী টাচ’। ১৯৯৩ সালে বড় ভাই লাকী আখান্দে্র উদ্যোগে বের হয় হ্যাপীর একমাত্র একক অ্যালবাম ‘শেষ উপহার’। অ্যালবামের প্রচ্ছদে লেখা ছিল, ‘বন্ধুরা আমার গান গেয়ো, আমাকে বাঁচিয়ে রেখো: জিয়া হাসান আখান্দ্ হ্যাপী।’
১৯৯০ সালে প্রকাশিত ‘মেলা’ অ্যালবামের অন্তর্ভুক্ত ‘পালকি’ গানে হ্যাপী আখান্দে্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করে ফিডব্যাক। গানটি ছিল আহমেদ ইউসুফ সাবের ও মাকসুদুল হকের যৌথ রচনা। গানের ভূমিকার কয়েক লাইন ছিল এ রকম, ‘সেদিন ছিল ফিডব্যাকের শীতকালীন মহড়া। ২৮ ডিসেম্বর ১৯৮৭। এক হিমেল সন্ধ্যা। হঠাৎ একটি খবর চমকে দিল আমাদের। হ্যাপী নেই। থেমে গেল মহড়ার উচ্ছ্বাস। শিল্পীর মৃত্যু নেই। আমাদের বিশ্বাস, হ্যাপী আখান্দে্র মৃত্যু নেই। তাঁর এই চলে যাওয়া মৃত্যুযাত্রা নয়। অন্য সুরের ভুবনে বরবেশে এ যেন হ্যাপীর পালকি চড়ে মহাপ্রস্থান। তাঁকে বলে দাও, আমি সেদিনের কথা ভুলিনি...’।
১৯৭৩ সালে বড় ভাই লাকী আখান্দে্র সঙ্গে একটি ব্যান্ড গড়েন হ্যাপী। ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ব্যান্ডটি ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর হ্যাপীর নামে ব্যান্ডের নামকরণ করেছিলেন ‘হ্যাপী টাচ’। ১৯৯৩ সালে বড় ভাই লাকী আখান্দে্র উদ্যোগে বের হয় হ্যাপীর একমাত্র একক অ্যালবাম ‘শেষ উপহার’। অ্যালবামের প্রচ্ছদে লেখা ছিল, ‘বন্ধুরা আমার গান গেয়ো, আমাকে বাঁচিয়ে রেখো: জিয়া হাসান আখান্দ্ হ্যাপী।’
হ্যাপীকে ভুলে যাননি বন্ধুরা
হ্যাপীকে ভুলে যাননি তাঁর বন্ধুরা। তাঁরা এখনো গেয়ে চলেছেন তাঁর গান, স্মৃতির ভেতর বাঁচিয়ে রেখেছেন মানুষটিকে। প্রয়াত ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চু প্রায়ই বলতেন, ‘বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতে প্রথম ধাক্কা ছিল হ্যাপীর চলে যাওয়া। ওই শূন্যতা আর কখনো পূরণ হবে না।’ তবু ফিডব্যাকের গানের মতোই সত্যি কথা—শিল্পীর মৃত্যু নেই।
হ্যাপী আখান্দে্রও মৃত্যু নেই। তাঁর সুর, কণ্ঠ ও গান এখনো প্রতিদিন কোনো না কোনো সন্ধ্যায় নতুন করে জন্ম নেয়—রেস্তোরাঁগুলোর গানের আসরে শিল্পীর তালিকায় একটা ‘হ্যাপী’ থাকেই।
কত অল্প সময়েই না তিনি নিজের ছাপ রেখে গেছেন! মাত্র ২৭ বছরের জীবন অথচ স্মৃতি যেন অগণন বছরের। ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ বাজলেই যেন আবার ফিরে আসেন তিনি—পাতলা খান লেনের এক তরুণ, হাতে স্প্যানিশ গিটার ও চোখে স্বপ্নের দীপ্তি। তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর গান এখনো প্রতিদিন নতুন করে জন্ম নিচ্ছে নতুন প্রজন্মের গলায়। যিনি জ্বলে উঠেছিলেন, নিভে যাননি কখনো। আজ ১২ অক্টোবর রোববার ফেসবুকে বহুজনের স্মৃতিতে ফিরে এসেছেন হ্যাপী।