
১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ট্রাক চালান ইমাম হোসেন। রাতের নীরব পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় জুবিন গার্গের গানে গানে শান্তি খুঁজে পেতেন তিনি। ইমাম হোসেন বাঙালি মুসলিম, যাঁরা আসামে ক্রমে আক্রমণের মুখোমুখি হচ্ছিলেন। তাঁরা প্রায়ই ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছিলেন। তবে এসব রাজনৈতিক আলাপ তাঁকে জুবিনের গান শোনা থেকে দূরে রাখতে পারেনি। এভাবেই জুবিন ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে হয়ে উঠেছিলেন সবার শিল্পী। বলা যায়, ধর্মীয় বিভাজনের মধ্যে হিন্দু গায়ক জুবিনের গান যেন মিলনস্থল হিসেবে কাজ করেছিল। আল–জাজিরাকে ইমাম হোসেন বলেন, ‘তাঁর সংগীত আমার অন্তরের শান্তি ছিল।’
জুবিন গত ১৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের লাজারাস দ্বীপে মারা যান। ৫২ বছর বয়সী এই শিল্পীর হঠাৎ মৃত্যু আসাম তো বটেই পুরো ভারতকেই যেন নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। তাঁর মৃত্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও শোক প্রকাশ করেছেন। মোদি বলেন, ‘তিনি তাঁর সংগীতে মানুষের অন্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁর সংগীত সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল।’
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, ‘রাষ্ট্র তার প্রিয় সন্তানদের একজনকে হারিয়েছে। জুবিনের কণ্ঠের শক্তি অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং তাঁর সংগীত আমাদের মন ও আত্মার সঙ্গে কথা বলেছে। তিনি এমন একটি শূন্যস্থান রেখে গেলেন যা কখনো পূরণ হবে না।’ আসাম সরকার চার দিনের শোক ঘোষণা করেছিল।
বিভাজনের মধ্যে ঐক্যের সুর
গত ২৩ সেপ্টেম্বর চার দিনের রাষ্ট্রীয় শোকের পর জুবিনের মরদেহ দাহ করা হয়। এর আগে ২১ সেপ্টেম্বর গুয়াহাটির বিমানবন্দরের বাইরে হাজার হাজার ভক্ত সমবেত হন। তারা পোস্টার হাতে, মোমবাতি হাতে, তাঁর জনপ্রিয় গানগুলো একসঙ্গে গাইতে গাইতে কনভয় অনুসরণ করেন।
এই দৃশ্যগুলো আসামের সম্প্রতি গভীর হিন্দু-মুসলিম এবং ভাষাগত বিভাজনের মধ্যে এক বিরল একতা দেখিয়েছে। আসামের স্থানীয় অসমিয়াভাষী এবং বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায় দুই শতাব্দী বিভাজন স্পষ্ট। ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা এবং ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বাঙালি মুসলিম ও হিন্দুদের অভিবাসনকে ঘিরে নানা সময়ে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
জুবিনের গান তৈরি হয়েছে এই বিভাজনের মধ্যেই। তিনি প্রায়ই নিজেকে একজন নিরপেক্ষ এবং ‘সামাজিক বামপন্থী’ হিসেবে পরিচয় দিতেন এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো থেকে দূরে থাকতেন। তিনি ভারতের জটিল জাতপাত ব্যবস্থারও কঠোর সমালোচক ছিলেন। একটি ভিডিওতে, তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি শুধু একজন মানুষ। আমার কোনো জাত, ধর্ম বা ঈশ্বর নেই।’ ২০১৮ সালে জুবিন প্রখ্যাত অসমিয়া নারী খেলোয়াড় হিমা দাসকে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় শক্তি অর্জনের জন্য গরুর মাংস খাওয়ার পরামর্শ দেন। যা নিয়ে তখন প্রচণ্ড বিতর্ক হয়।
জুবিন ২০১৯ সালে ভারতের বিতর্কিত নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করেও সাম্প্রতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন।
‘শিল্পী ও মানবিক’
জুবিন গার্গ ১৯৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিন বছর বয়সে তিনি গাইতে শুরু করেন এবং অল্প সময়েই খ্যাতি পান। ১৯৯২ সালে তাঁর প্রথম অসমিয়া অ্যালবাম ‘অনামিকা’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী জীবনে তিনি ৩৮ হাজারের বেশি গান গেয়েছেন। ২০০৬ সালে ‘গ্যাংস্টার’ সিনেমায় ‘ইয়া আলী’ হিট হওয়ার পর তিনি জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত হন।
গবেষক অংশুমান চৌধুরী বলেন, জুবিন ছিলেন এমন এক শিল্পী যিনি প্রচলিত ‘সংযত’ থাকার নিয়ম ভেঙেছিলেন। তিনি মঞ্চে কখনো মদ্যপ অবস্থায় গান গাইতেন, কখনো অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করতেন; প্রচলিত নিয়মের প্রতি প্রকাশ্য অসন্তোষ দেখাতেন। তিনি কখনো বিহু উৎসবে গান গাওয়ার জন্য সম্মতি দেননি যদি তাকে হিন্দিতে গান করতে না দেওয়া হয়।
সমাজকর্মী পৃথ্বিরাজ বোরা বলেন, ‘জুবিনের গান শুধু বিনোদনই নয়; মানুষের অস্তিত্ব, ভালোবাসা, কষ্ট ও অর্থ খোঁজার বিষয়েও কথা বলেছে।’
সবার জন্য সংগীত
আসামের স্বাস্থ্যকর্মী আবরার নাদিম বলেছেন, তিনি চার বছর বয়স থেকে জুবিনের অধিকাংশ গান মুখস্থ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তার গান আমাকে আধ্যাত্মিক শান্তি দিয়েছে।’
অসমিয়া গীতিকর ও কবি মৈত্রী পাটার বলেন, ‘জুবিনের মানবিক দিক সবাইকে ছুঁয়ে যেত। তিনি বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, এ জন্যই তিনি সবার প্রিয় শিল্পী ছিলেন।’
ট্রাকচালক ইমাম হোসেন বলেন, জুবিন বাঙালি মুসলিমদের কখনো নিন্দা করেননি। মুসলিম মাদ্রাসার ছাত্ররাও তাঁর গান বাজাতেন, মুসলিম নেতারাও তাঁর গান শুনতেন। তাঁর গান হিন্দু-মুসলিম, অসমীয়া-বাঙালি সবার জন্য; শুনতে অসম্ভব মনে হলেও এটাই সত্যি।
তথ্যসূত্র: আল–জাজিরা