পারভেজ সাজ্জাদ
পারভেজ সাজ্জাদ

ম্যাশআপে বাজিমাত পারভেজের

২০০৮ সালে হৃদয় মিক্স দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন পারভেজ সাজ্জাদ। ‘যাবি যদি উড়ে দূরে নীল অজানাতে’ গানটি সে সময় বেশ সাড়া ফেলেছিল। এরপর কেটে গেছে দেড় দশক। সম্প্রতি এই গায়কের গাওয়া লোকগানের একটি ম্যাশআপ দেড় শ মিলিয়ন ভিউ পার করেছে। তৈরি আছে আরও ২০টির মতো নতুন গান। শত গানের একটি প্রকল্পে কাজ করছেন। গতকাল দুপুরে তাঁর গল্প শুনেছেন মনজুর কাদের

পারভেজ সাজ্জাদের সন্তান আকাইদ সাজ্জাদ, মা–বাবা তাঁকে শ্রেষ্ঠ নামে ডাকতেন। গত জুনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান শ্রেষ্ঠর মা অভিনয়শিল্পী সীমানা। এর পর থেকে বাবা পারভেজের অধিকাংশ সময় সন্তানের সঙ্গে কাটে। স্টেজ শো, গানের রেকর্ডিং বা বিশেষ কোনো কাজ ছাড়া বাসার বাইরে যান না। মাঝেমধ্যে ছেলেকে সঙ্গে নিয়েও রেকর্ডিং স্টুডিওতে যান। ছেলে তার দাদি এবং দুই ফুফুর ‘জানের জান’, ‘কলিজার টুকরা’ উল্লেখ করে পারভেজ বলেন, ‘আমার ছেলেটা মা হারানোর দুঃখ আজীবন বয়ে বেড়াবে। আমি মনে করি, বাবার না থাকা কিছুটা হলেও পূরণ করা যায়; কিন্তু মায়ের অপূর্ণতা কোনোভাবেই পূরণ হয় না।’
ছেলের মায়ের মৃত্যুর পর জীবন অনেকটাই বদলে গেছে, জানালেন এই গায়ক। পারভেজ বলেন, ‘জীবন চলবে। পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। যেখানে পছন্দের কোনো অপশন নেই। এই জীবনও ভালো। ২৪ ঘণ্টা ছেলেটা আমার চোখের সামনে আছে, এটা খুবই স্বস্তির বিষয়। তবে ওর কষ্টটা যখন দেখি, তখন তা আমাকে হার্ট করে। ভাবতে থাকি, ও তো এ রকম জীবন প্রাপ্য ছিল না। এই বয়সেও আমার মা আছে। কোনো কষ্ট বা অন্য কোনো অনুভূতি, আনন্দের কথা শেয়ার করার জন্য মায়ের নম্বরে প্রথম ডায়াল করি। কিন্তু আমার ছেলেটার চিন্তার জায়গাটাই শেষ হয়ে গেল। মা না থাকাটা কত বড় অভাব, কল্পনাও করতে পারি না। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুবই বন্ধুর মতো। আমরা একসঙ্গে স্কুল থেকে যাওয়া–আসার সময় নানা বিষয়ে কথা বলি। বন্ধুত্বের জায়গা ডেভেলপ করে নিয়েছি। ওর মা বেঁচে থাকার সময়েও করেছি।

সবকিছুর পরও বিরাট শূন্যতার জায়গা রয়েছে। একটা বাচ্চাকে যখন তার মা আদর করে, তখন দেখি সে তাকিয়ে থাকে। আনমনা হয়ে যায়। বেশির ভাগ সময় আমাকে বলে না। সবচেয়ে বড় বিষয়, এই বয়সে কষ্ট লুকানো শিখে গেছে, যেটা একজন বাবা হয়ে সহ্য করা যায় না।’

১৫০ মিলিয়ন ছাড়িয়ে
বিজয় সরকারের ‘তুমি জানো না রে প্রিয় তুমি মোর জীবনের সাধনা’, হাসন রাজার ‘সোনা বন্দে আমারে দিওয়ানা বানাইল’, ‘লোকে বলে’, শাহ আবদুল করিমের ‘বন্দে মায়া লাগাইছে’, ‘কেমনে ভুলিব আমি’, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘আছেন আমার মোক্তার’, মুজিব পরদেশীর ‘আমার সোনা বন্ধু রে’, ‘সোনা দিয়া বান্ধাইয়াছি ঘর’, নজরুল ইসলাম খানের ‘দয়াল বাবা কেবলা কাবা’, আলাউদ্দিন বয়াতির ‘মন আমার দেহ ঘড়ি’—এই ১০টি গানের সংকলনে বাংলা ফোক ম্যাশআপ করেছিলেন ডিজে রাহাত, যেটিতে কণ্ঠ দেন পারভেজ সাজ্জাদ। পাঁচ বছর আগে প্রকাশিত সে গানটি সম্প্রতি দেড় শ মিলিয়ন ভিউ ছাড়িয়েছে। ১০ লাখ লাইক পড়েছে এবং মন্তব্য জমা পড়েছে ৪৪ হাজারের মতো। এটাকে অনেক বড় অর্জন মনে করছেন পারভেজ। কেননা বাংলা লোকগানের কোনো ম্যাশআপে এত বেশি সাড়া পড়েনি।

কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, প্রথমত গানগুলো খুবই চেনা। সংগীতায়োজনে একেবারে আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল। গায়কিতে ঐতিহ্যের ছাপ ছিল। প্রচলিত গায়কির সঙ্গে সংগীতের আধুনিকতা চমৎকারভাবে ব্লেন্ড হওয়ার কারণে ট্র্যাকটাকে সবাই এভাবে ভালোবেসেছে। তা ছাড়া লোকগানের আবেদন সর্বজনীন। এ গানটি আমি বাজতে শুনেছি ইউকে, থাইল্যান্ড ও ভারতের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও ক্লাবে। গানটিতে নতুন ধরনের সাউন্ড ডিজাইন পেয়েছেন মানুষ।’

পারভেজ সাজ্জাদ

নতুন পরিকল্পনা
১৭ বছরের সংগীতজীবনে তিনটি একক গানের অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন পারভেজ সাজ্জাদ—পথ (২০০৯), প্রহর (২০১২) ও পাগল (২০১৬)। এ ছাড়া বিভিন্ন সম্মিলিত অ্যালবামেও গেয়েছেন। প্রকাশিত হয়েছে একক গানও। পারভেজকে লোকগান ও মৌলিক গানের আরেকটি প্রকল্পে দেখা যাবে। রি ডু নামের সেই প্রকল্পের উদ্যোক্তা ডিজে রাহাত, সংগীতায়োজন করেছেন আদিব করিম। পারভেজ জানান, তাঁদের এই প্রকল্পে ৫০ জন শিল্পীকে ১০০ গানে পাওয়া যাবে। পারভেজ বলেন, ‘আমার আর রাহাতের বরাবরই চিন্তা ছিল, বাংলা গান নিয়ে কাজ করার। আমরা যে অনুষ্ঠানই করি, বাংলা গান তাতে প্রধান্য পায়। অথচ একটা সময় এই আমরাই দেখেছি, যেকোনো অনুষ্ঠানে হিন্দি গান ছাড়া অপূর্ণ লাগত। এখন সেসব অনুষ্ঠান আমাদের বাংলা গানে পূর্ণতা পায়। কিছুই না, সবই ঠিক আছে, শুধু সাউন্ড ডিজাইন নিয়ে ভেবেছি। আমরা চেয়েছিলাম, পার্টিতে বাংলা গান বাজাব। পার্টির মুড অনুযায়ী বাংলা গান বাজবে। সাউন্ড ডিজাইনে আদিব কবির দুর্দান্ত কাজ করেছে। ওর সাউন্ডই অন্য রকম। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের লিরিক, টিউন সব দিক দিয়ে দারুণ অবস্থানে আছি, শুধু সাউন্ড ডিজাইন ঠিকঠাক করলেই হয়, যেটায় আমরা ভালোভাবে নজর দিয়েছি।’

গত বছর ঈদুল আজহায় ‘বিড়ি’ নামে একটি গান গেয়েছিলেন পারভেজ। তিনি জানান, মজার সে গানটি মানুষকে আনন্দ দিয়েছে। নতুন ২০টি গান তৈরি আছে। সময়–সুযোগ বুঝে এসব গান প্রকাশ করতে চান। পারভেজ বলেন, ‘গাওয়ার পাশাপাশি এসব গানের কয়েকটি আমার লেখা ও সুর করা। গানগুলো ডিজাইনের সময় বর্তমান সময়টার কথা মাথায় ছিল। আমার স্বপ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মিউজিক বিশ্ব আঙিনায় উপস্থাপন করা। সেভাবে আমার গানগুলোর সাউন্ড ডিজাইন করছি।’

পারভেজ সাজ্জাদ

লোক ও সুফিতে প্রেরণা
১৭ বছরে হাতে গোনা কয়েকটি আধুনিক গান গেয়েছেন পারভেজ। শুরু থেকেই তাঁকে লোক ও সুফি ধাঁচের গানে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। এটা নিজের চাওয়া, নাকি কৌশল—এমন প্রশ্নে পারভেজ বলেন, ‘প্রথমত এ দুটি ধারায় আমি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করি। সুফি নিয়ে কাজ করার ভাবনা হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তার দর্শন নিয়ে কাজ করা। তাঁর দর্শন মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। লোকগান তো আমাদের মাটির গান। আমাদের দেশের পরিচয়, শিকড়ের গান, অস্তিত্ব—সেটাকে পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার চিন্তা। আমাদের লোকগানগুলো যারা এখন গাইছে, সঠিক তথ্য-উপাত্তসহ বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করা উচিত। শিল্পীদেরই এসব করতে হবে।’ দেশে ও দেশের বাইরে লোক ও সুফি গানে অনেকে তাঁকে নানাভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁদের মধ্যে নুসরাত ফতেহ আলী খানকে আদর্শ মানেন পারভেজ। অন্যদের মধ্যে কৈলাশ খের, রাহাত ফতেহ আলী খান, শাফকাত আমানত আলী খান, সাব্বির ব্রাদারস, আবিদা পারভীন। আর লোকগানে মামে খান, সুখবিন্দর সিং, রথীন্দ্রনাথ রায় খুব প্রিয়। পারভেজ জানান, রথীন্দ্রনাথ রায়ের অন্ধভক্ত তিনি। তাঁর কণ্ঠ শুনলে উন্মাতাল হয়ে যান।