বাউলশিল্পী তরিকুল ইসলাম, যিনি ‘গামছা বাউল ডালিম’ নামে এলাকায় পরিচিত ছিলেন
বাউলশিল্পী তরিকুল ইসলাম, যিনি ‘গামছা বাউল ডালিম’ নামে এলাকায় পরিচিত ছিলেন

গামছা ডালিমের জীবন গাড়ি আর ‘ব্যাক গিয়ারে’ ফিরবে না

‘জীবন গাড়ির নাই রে ব্যাক গিয়ার…।’

গত মঙ্গলবার নিজের ফেসবুক পেজে এই ছোট্ট স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন রাজশাহীর জনপ্রিয় বাউলশিল্পী তরিকুল ইসলাম, যিনি ‘গামছা বাউল ডালিম’ নামে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। কে জানত, মাত্র দুদিন পরই এই বাক্য যেন সত্য হয়ে যাবে তাঁর জীবনের জন্য! গতকাল বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) দুপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারান ৩৪ বছর বয়সী এই শিল্পী (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

তরিকুল ইসলাম ওরফে ডালিম ছিলেন দুর্গাপুর পৌর এলাকার হরিপুর মহল্লার বাসিন্দা। তাঁর মাথায় গামছা বাঁধা ছিল এক অনন্যপরিচয়। টেলিভিশনের পর্দা থেকে শুরু করে ঘরোয়া মঞ্চ—সবখানেই তাঁকে দেখা যেত, সেই গামছা বেঁধে গান গাইতে। ফেসবুক পেজের নামটাও তা–ই ছিল, ‘গামছা বাউল ডালিম’।

সেই পেজে ঢুকলেই চোখে পড়ছে তাঁর অসংখ্য গানের ভিডিও, ‘মায়ের এক ধার দুধের দাম, কাটিয়া গায়ের চাম’, ‘নিথুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে’, ‘পাগলা ঘণ্টা বানাইছে রে বড় পাগলে’, ‘আমায় কি মনে পড়ে না’, ‘রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিঞ্জর বানাইছে’, ‘চাতুরি করিয়া মোরে সাদা দিলে কাদা লাগাই গেলি’, ‘কলিজাতে দাগ লেগেছে’, কিংবা ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’—এসব গান কখনো স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের শেখাচ্ছেন, কখনো মঞ্চে বা ওষুধ কোম্পানির অনুষ্ঠানে গাইছেন।

বাউলশিল্পী তরিকুল ইসলাম

গান ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। বাবাও ছিলেন বাউলশিল্পী। বাবার হাতেই হাতেখড়ি। স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন ডালিম। রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন মঞ্চে নিয়মিত গাইতেন। দুর্গাপুর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমিতে সংগীত প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন। পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের জন্য বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) দুর্গাপুর কার্যালয়ে সহকারী ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে দৈনিক মজুরিতে কাজ করতেন ১০–১২ বছর ধরে। নিয়মিত বেতন না পেলেও জীবনের বড় অংশ গানেই বিলিয়ে দিয়েছিলেন।

তাঁর চাচাতো ভাই আলমগীর হোসেন জানান, ‘ঈদের আগে জীবনে প্রথমবারের মতো ওর কিছু বেতন হয়েছিল। বৃহস্পতিবার সকালে সে আমার কাছে এসেছিল। ফেসবুক পেজ মনিটাইজ হয়েছে, এ নিয়ে কিছু জানতে চাইছিল। বলল, একটু কাজ আছে, পরে আবার আসবে। এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও সে আর আসেনি। বিকেলে খবর এল, সে আর নেই। বিশ্বাস হচ্ছিল না। ওর বাবাও কিছু বলছিল না, শুধু বুক চাপড়াচ্ছিল।’

বাউলশিল্পী তরিকুল ইসলাম

জানা যায়, দুর্গাপুর উপজেলার শ্রীপুর গ্রামে একটি গভীর নলকূপে বৈদ্যুতিক গোলযোগ দেখা দেয়। ডালিম সেখানে গিয়েছিলেন মেরামত করতে। কিন্তু অপারেটর না থাকায়, দ্রুত কাজ সারতে গিয়ে ছাদের ওপরে ওঠেন। মই দিয়ে নামার সময় খেয়াল না করেই তিনি বিদ্যুতের লাইনের খুব কাছে চলে যান। মইটি লাইনের সংস্পর্শে যেতেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনি ছিটকে পড়েন। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। আরও মর্মান্তিক তথ্য—ঘটনার দিন সকালে ডালিম নিজের ফেসবুকে কয়েকটি ট্রান্সফরমারের ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, ‘কারা বলতে পারবেন, এগুলোর সঠিক নাম? যাঁরা পারবেন, তাঁদের জন্য গিফট আছে।’ কয়েক ঘণ্টা পরই সেই বিদ্যুতেই জীবন গেল তাঁর।
এখন তাঁর ফেসবুক পেজে ঘুরেফিরে ভেসে ওঠে সেই গান—
‘যে দিন পরান উড়ি উড়ি দিবে আকাশ পাড়ি
ধুলার মাঝে থাকবে পড়ে দম ফুরানো একটা হাওয়ার গাড়ি।’
ঠিক তেমনই, ডালিমের জীবন থেমে গেছে। দম ফুরানো একটা হাওয়ার গাড়ির মতো। আর কখনো বাজবে না তাঁর গলায় বাউলের সুর।