
স্কুলজীবনে বন্ধুদের সঙ্গে শখের বশে গিটার বাজাতেন বালাম। সেই শখই পরে পেশা হয়ে যায়। সম্প্রতি তিনি ক্যারিয়ারের তিন দশক পূর্ণ করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে উপহার দিয়েছেন শ্রোতাপ্রিয় অনেক গান। গেল নভেম্বরে মুক্তি পেয়েছে ‘দরদ’ সিনেমার গান।নতুন গান, ক্যারিয়ার নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন মনজুরুল আলম।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন কী করছেন?
যুক্তরাষ্ট্রে আমার ভাই থাকে, তার এখানেই আছি। মূলত স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঘুরতে এসেছি। পরিবারকে সময় দিচ্ছি। পাশাপাশি গানের মানুষ, বসে তো থাকা যায় না, গান করছি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দরদ সিনেমার ‘এই ভাসাও’ গানেও কণ্ঠ দিয়েছি। ২০২৫ সালে আরও গান প্রকাশ করব, সেগুলোর কাজ চলছে। আমার ভাইও শখে গান করে, তার স্টুডিও রয়েছে। এটা আমার জন্য আরও সুবিধার হয়েছে। এ ছাড়া কিছু গানের মিউজিক ভিডিওর শুটিং করে রাখছি। ঘোরাঘুরির পাশাপাশি গানের কাজও এগিয়ে নিচ্ছি।
সংগীতজীবনের ৩০ বছর পূর্ণ করলেন, শুরুটা কেমন ছিল?
কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই গানে এসেছি। পরিবারে আমার মা-বাবা, ভাই, চাচা, ফুফু, কাজিনেরা গান করতেন। শৈশব থেকেই গানের পরিবেশে বেড়ে ওঠা। গিটার বাজিয়ে গান করতে পছন্দ করতাম। এভাবে গান করতে করতে গানের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। পরে শুধু মিউজিক করে গেছি। গান নিয়ে জীবনের উত্থান-পতন দেখেছি। মনোবলই আমাকে এগিয়ে নিয়েছে। পারব না কেন, এই কথাই আমাকে আজকের জায়গায় নিয়ে এসেছে।
ভালোবাসা থেকে গান কখন পেশা হয়ে উঠল?
তখন স্কুল শেষ করে কলেজে পড়ছি, এমন সময় বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের প্রথম ব্যান্ড গড়া। সে সময়ে একটা ব্যান্ড উৎসবে অংশ নিই। শুরুতেই আমরা সেই উৎসব থেকে পুরস্কার জয় করি। তখন একটা কথাই মনে হয়েছে, আমাদের দিয়ে তাহলে গান হবে। নিজের ওপর আস্থা আরও বাড়ল। মনে হয়েছে, গান আমরা পারব। কিন্তু পেশা হিসেবে তখনো ভাবিনি। প্রথম অ্যালবাম জনপ্রিয় হওয়ার পর ভক্তদের একটা প্রত্যাশা তৈরি হলো। দায়বদ্ধতা বাড়ল। তখন মনে হলো, গান পেশা হতে পারে। ভালোবাসা থেকে পেশা আসলে ভাগ্যের ব্যাপার। ৩০ বছর আগে যে প্রাপ্তি দিয়ে শুরু করেছিলাম, ৩০ বছর পর এই সময়ের কথা যদি বলি, তাহলে আমাদের নতুন প্রাপ্তি ‘প্রিয়তমা’ গানের সম্মাননা, যে গান আমাকে এখনো স্বীকৃতি দিয়ে চলছে। মাঝখানে তো আরও প্রাপ্তি আছেই।
গানকে পেশা হিসেবে নেওয়াটা পরিবারের লোকেরা কীভাবে দেখতেন?
তাঁরা চাইতেন, আমি গান করি। কিন্তু পেশা হিসেবে একটু নিরাপদ কোনো কিছুর সঙ্গে থাকতে বলতেন। এমবিএতে পড়ার জন্য চাপ দিতেন। বিদেশে পড়াশোনা করতে যেতে বলতেন। পরে যখন দেখলেন, গান নেশা, তখন সংগীত নিয়ে বাইরে পড়তে যেতে বলতেন। সেই গানের নেশা থেকে এখনো বের হতে পারিনি।
তিন দশক আগে তো অনেক জনপ্রিয় ব্যান্ড ছিল, সেসব কতটা প্রভাব রেখেছিল?
আমরা ভালো একটা সময়ে গান নিয়ে বেড়ে উঠেছি। তখন মাইলস, এলআরবি, ফিডব্যাক, সোলসের গান প্রচুর শুনেছি। রক মিউজিকের মধ্যে ওয়ারফেজ, রকস্টার ইন ঢাকার গান শুনতাম। মাইলসের বাবনা করিম ভাই আমার কাজিন ছিলেন। তাঁর সঙ্গে গান নিয়ে প্রচুর আড্ডা হতো। সেই সময় আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ—তাঁদের গান শুনে অনুপ্রেরণা নিতাম। তখন তো অনলাইন ছিল না। বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনের (বামবা) মিউজিক ফেস্টিভ্যালের জন্য অপেক্ষা করতাম। সরাসরি গান শুনতে ছুটে যেতাম। রেডিও, ক্যাসেটে নিয়মিত গান শুনতাম। সুন্দর একটি পরিবেশ আমাকে গানে টেনেছে।
যে প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করেছিলেন, সেখানে কী যেতে পেরেছেন?
প্রত্যাশা বলতে, ভালো লাগা থেকে গান করা শুরু। এরপর ভক্তদের ভালোবাসা পেয়েছি। এখনো পেয়ে যাচ্ছি, যা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। আমার প্রাপ্তি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু প্রত্যাশা তো সব সময় এক রকম থাকেনি। বেড়েছে। এখনকার প্রত্যাশা, গ্লোবালি বাংলা গান নিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছানো। বাংলা গানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে হবে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের গান কোন পর্যায়ে রয়েছে?
স্পটিফাই, ডিজিটালসহ নানা মাধ্যমে আমাদের গান ছড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের গান এখন গ্লোবাল ট্রেন্ডিংয়েও জায়গা করে নিচ্ছে। ‘ও প্রিয়তমা’ তো কয়েক সপ্তাহ ছিল। কোক স্টুডিওর গান জায়গা করে নিয়েছিল। এখন মূল কাজ নিয়মিত ভালো ভালো গান করা। প্রায়ই বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে স্প্যানিশ, লাতিনসহ বিভিন্ন ভাষার গান টপচার্টে আসছে। সেখানে একদিন আমরাও নিয়মিত হব।
পিছিয়ে থাকার কী কী কারণ থাকতে পারে?
সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের গানকে শত শত কোটির বাজারে রূপান্তর করার লোক নেই। আমাদের শুনতে হয় থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি, আমাদের গান হিট হলে রয়্যালটি নিয়ে ভাবতে হয়। আমাদের একজন শিল্পীকে শেষজীবনে অর্থকষ্ট করতে হয়। বড় পরিসরে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে গান নিয়ে চিন্তা করার লোক দরকার। মাইকেল জ্যাকসনকে যদি ছোট ছোট টেলিভিশন চ্যানেলে, ছোট ছোট কনসার্টে দেখা যেত, তাহলে তিনি কি এত বড় জায়গায় পৌঁছাতে পারতেন। যে কারণে আমাদের পেছনে শক্ত শক্তি দরকার। সেটা না থাকায় আমাদের মেধাবী শিল্পীরা নিজেরাই ধীরে ধীরে এগোচ্ছেন। আশাবাদের কথা হচ্ছে, সাফল্যের দিন খুব বেশি দূরে নেই।
কোনো ভুল সিদ্ধান্ত ক্যারিয়ারে ক্ষতি করেছে?
আমার জীবনে কখনোই অতীত নিয়ে ভাবি না। কোনো একটা ঘটনা কোনো এক সময় ঘটেছে, সেটাকে কখনোই সামনে আনিনি। অতীত মানে অতীত। মনে করেছি, যা ঘটেছে ভালোর জন্য ঘটেছে। ক্যারিয়ার নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। আবার আমাকে এটা-সেটা হতে হবে, সেটাও কখনোই ভাবিনি।
প্রথম অ্যালবাম ‘বালাম’ মুক্তির পর দর্শকদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
২০০৮ সাল আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে। আমার প্রথম অ্যালবাম বালাম নিয়ে এটাই মনে হয়েছিল, শ্রোতারা গানগুলো শুনবেন। কিন্তু শ্রোতারা যে গান নিয়ে এত বেশি ক্রেজি হবেন, ভাবতেই পারিনি। সেই প্রথম ক্রেজি ভালোবাসা পাই, যা আমার প্রত্যাশার শতগুণ বাইরে ছিল। তখন সারা দেশের যেখানে গিয়েছি, দর্শক ঘিরে ধরেছেন। সব জায়গায় গান বাজতে শুনেছি। তখনই গান নিয়ে দায়বদ্ধতা, চিন্তা বেড়ে যায়।
জনপ্রিয়তা কি চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছিল?
আগে আমি নিজের পছন্দে গান করতাম। তা নিয়ে কে কী বলত, ভাবতাম না। নিজের ভালো লাগা শেয়ার করতাম। কিন্তু পরে দেখা গেল, দর্শকেরা আমার কাছে আরও গান চান। তখন ভাবনায় পড়ে যাই। কোনো গান করার ক্ষেত্রে চিন্তা হতে থাকে, এটা দর্শক পছন্দ করবেন কি না। আমার পছন্দ আর চিন্তাভাবনা নিয়ে ক্যারিয়ারে এগিয়েছি।
এই পথচলায় সবচেয়ে বেশি অবদান কার?
আমার পরিবারের মানুষই সবচেয়ে অনুপ্রাণিত করেছে। এই পথচলায় মা-বাবাই অনুপ্রেরণা। কাছের মিউজিশিয়ান বন্ধুদের নিয়ে যখন কলেজ শেষ করে একসঙ্গে বসতাম, সেই দিনগুলোর আবদান রয়েছে। বিয়ের পর আমার স্ত্রী গান নিয়ে উৎসাহ দিয়েছে। বিশেষ কারণে পাঁচ বছরের মতো গান থেকে দূরে ছিলাম। পরে স্ত্রীর উৎসাহে আবার গানে ফেরা।
বর্তমানে সংগীতাঙ্গনের কোন পরিবর্তন ভাবায়?
অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল হয়েছে, এটা সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সেই সঙ্গে সবাই এখন রয়্যালটি পাচ্ছেন, যা আশার কথা। আমাদের অনেক সিনিয়র শিল্পী গানের প্রাপ্য রয়্যালটি পাননি, যা তাঁদের পাওয়া উচিত ছিল। তাহলে সিনিয়র শিল্পীদের খারাপ দিন দেখতে হতো না। সবার কথা বলছি না, গুণী অনেককেই সহায়তা চাইতে হতো না। ঠিকভাবে শিল্পীর রয়্যালটি বুঝিয়ে দিতে হবে। বেঁচে থাকলেই ক্রিয়েটিভিটি ক্রিয়েট হবে। আরেকটা ভালো পরিবর্তন, এখন শিল্পীদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কাছে ধরনা দিতে হয় না। মেধা থাকলে যে কেউ গান করে প্রকাশ করতে পারেন। এতে অনেক খারাপ কাজ সামনে এলেও অনেকের দৌরাত্ম্য কমেছে। মেধাবী নতুনেরাও সুযোগ পাচ্ছেন।
নতুন গানের খবর বলুন।
ব্যস্ততা তো অনেক গান নিয়ে। চাইলে মাসে একটি গান রিলিজ দেওয়া যায়। তবে আমি দুই মাসে একটি করে গান রিলিজ দেব, সে পথেই হাঁটছি। গানগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রে বসেই সাজাচ্ছি। আগেই কিছু মিউজিক ভিডিওর শুটিং করছি। এর মধ্যে সিনেমার গান করার কথা রয়েছে। এখান থেকেই কণ্ঠ দেব। এ মাসেই দেশে গিয়ে গান নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করব।