দুই সন্তান বাঁধন ও শ্রাবণের সঙ্গে সংগীতশিল্পী মা সাবিনা ইয়াসমীন
দুই সন্তান বাঁধন ও শ্রাবণের সঙ্গে সংগীতশিল্পী মা সাবিনা ইয়াসমীন

সাবিনা ইয়াসমীনের সন্তানেরা কে কী করেন

বাংলা গানের ইতিহাসে এক অনন্য নাম সাবিনা ইয়াসমীন। অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে যাঁর কণ্ঠে ভেসেছে ভালোবাসা, বেদনা, আনন্দ আর দেশপ্রেমের সুর। তাঁর গান বাঙালির জীবনের আবেগের প্রতিচ্ছবি হয়ে আছে আজও। গুণী এই শিল্পীর দুই সন্তান পেশায় ব্যস্ত নিজ নিজ জগতে। মেয়ে ইয়াসমীন ফাইরুজ বাঁধন দেশে থাকেন, আর ছেলে রাফি হোসেন শ্রাবণ থাকেন লন্ডনে, কর্মরত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে। দুজনই মায়ের পথ অনুসরণ না করলেও বড় হয়েছেন সুর আর সংগীতময় পরিবেশে, কিংবদন্তি মায়ের আলোয়।

সাবিনা ইয়াসমীন ও তাঁর মেয়ে বাঁধন

কিংবদন্তি মায়ের গল্প

বাংলা চলচ্চিত্রে সাবিনা ইয়াসমীন মানেই এক মায়াময় কণ্ঠের নাম। শিশুশিল্পী হিসেবে সংগীতজগতে প্রবেশ তাঁর, রবিন ঘোষের সংগীতে ‘নতুন সুর’ ছবিতে প্রথম গান গাওয়া। তবে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ১৯৬৭ সালে জহির রায়হানের ‘আগুন নিয়ে খেলা’ চলচ্চিত্রে। আলতাফ মাহমুদের সংগীতে গাওয়া ‘মধু জোছনা দীপালি’ গান দিয়েই শুরু হয় এক কিংবদন্তির পথচলা।

এরপর ধীরে ধীরে সাবিনা ইয়াসমীন হয়ে ওঠেন বাংলা চলচ্চিত্রের অপরিহার্য কণ্ঠ। দীর্ঘ সংগীতজীবনে ১৬ হাজারের বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। পেয়েছেন স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক ও ১৪ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অসংখ্য স্বীকৃতি।

মেয়ে বাঁধনের সঙ্গে সংগীতশিল্পী মা সাবিনা ইয়াসমীন

মেয়ে বাঁধন: ব্যাংকার জীবনের ব্যস্ততা

সাবিনা ইয়াসমীনের মেয়ে ইয়াসমীন ফাইরুজ বাঁধন; পরিবারের সবাই তাঁকে বাঁধন নামেই চেনেন। টুকটাক গান গাইলেও সংগীতকে পেশা হিসেবে নেননি তিনি। বেছে নিয়েছেন ব্যাংকিং সেক্টরকে। পড়াশোনার বড় অংশ কেটেছে ঢাকায়, এরপর ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায়।

বাঁধন বলেন, ‘ঢাকার ম্যাপললিফ স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। এরপর ভারতের উত্তর প্রদেশের মুসোরিতে উডস্টক স্কুলে হাইস্কুল শেষ করি। তারপর বেঙ্গালুরুর গভর্নমেন্ট ফার্স্ট গ্রেড কলেজ থেকে ব্যাচেলর অব আর্টস, আর অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব ওলোংগঙ্গ থেকে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এমকম শেষ করি। ২০০২ সালে দেশে ফিরে ব্যাংকে যোগ দিই।’

ওয়ান ব্যাংকে ছয় বছর কাজের পর অন্য ব্যাংকে আরও ছয় বছর, এরপর গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আছেন আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকে। বর্তমানে তাঁর পদবি ফার্স্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট।

বাঁধন বলেন, ‘আমার জীবনের প্রতিটি সকালে গানের সুরে ঘুম ভাঙত। মা গান না গাইলেও ঘরে যেন সব সময় সুর ভাসত। তবে আমি নিজের মতো করে পথ বেছে নিয়েছি। মা কখনো বাধ্য করেননি, বরং সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন।’

ছেলে শ্রাবণের সঙ্গে সংগীতশিল্পী মা সাবিনা ইয়াসমীন

ছেলে শ্রাবণ: সংগীতের স্বপ্ন থেকে লন্ডনের বাস্তবতায়

বাঁধনের চেয়ে আট বছরের ছোট রাফি হোসেন, যাঁকে পরিবারের সবাই শ্রাবণ নামে ডাকেন। তিনিও মায়ের মতো সংগীতপ্রেমী, তবে পেশা হিসেবে সেই পথ বেছে নেননি। ঢাকার র‍্যাডিয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল শেষ করে দেড় দশক আগে যুক্তরাজ্যে যান তিনি। সংগীত বিষয়ে ভর্তি হন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সাবিনা ইয়াসমীন

সাবিনা ইয়াসমীন জানালেন, ‘শ্রাবণ গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ওখানে সংগীত নিয়ে পড়তে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেশাগতভাবে গান নেয়নি। তবে ওর জীবনে গান এখনো আছে মন থেকে।’ বর্তমানে শ্রাবণ লন্ডনের পরিচিত ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রয় প্রতিষ্ঠান হল্যান্ড অ্যান্ড ব্যারেটে চাকরি করছেন। সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন এক দশকের বেশি সময় ধরে।

সাবিনা ইয়াসমীনের দুই সন্তান ইয়াসমীন ফাইরুজ বাঁধন ও রাফি হোসেন শ্রাবণ

মায়ের ভাবনা

দুই সন্তান মায়ের মতো সংগীতকে পেশা না করলেও সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে গর্ব ও শান্তি, ‘এটা ওদেরই পছন্দ। আমি কখনো কিছু চাপিয়ে দিইনি। মেয়েটা (বাঁধন) ব্যাংকে ভালো করছে, আর ছেলেটা (শ্রাবণ) লন্ডনে নিজের অবস্থান গড়ে নিয়েছে, এতেই আমি খুশি। আমি দেখেছি, মা-বাবার পেশায় সন্তানেরা অনেক সময় আসতে চায় না। এলেও সাফল্য সব সময় হয় না।’ বাংলা গানের কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমীন তাই আজও বিশ্বাস করেন, জীবনের সাফল্য পেশায় নয়, আনন্দে। তাঁর গানের মতোই তাঁর জীবনের কথাও তাই মধুর, প্রেরণা আর অনুপ্রেরণাদায়ী, যেখানে সুর আছে, আছে স্নেহ, আর আছে পরিপূর্ণ মায়ের গর্ব।