‘এই বৃষ্টিভেজা রাতে তুমি চলে যেয়ো না’ রুনা লায়লার গাওয়া এই গানটিতে রাবাব বাজিয়েছেন যন্ত্রসংগীতশিল্পী নূরুল হক। সেই মানুষটি বৃষ্টিভেজা রাতেই না-ফেরার দেশে চলে গেলেন। এই গুণী শিল্পী গত বুধবার (২৮ মে) রাত আটটায় রাজশাহীর সিপাইপাড়ায় নিজ বাসায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁকে রাজশাহী নগরের হেতেম খাঁ গোরস্থানে দাফন করা হয়। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার প্রায় সারা দিন বৃষ্টি ঝরেছে। এ কারণে তাঁর বিদায়বেলায় বৃষ্টিভেজা রাতের গানটির কথাই বারবার মনে পড়ছে বন্ধু-স্বজনদের। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
এই মানুষটা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানে সন্তুর, ম্যান্ডোলিন, আমেরিকান ব্যাঞ্জো ও মাউথ অর্গান বাজিয়ে গানকে আরও শ্রুতিমধুর করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রসহ অন্যান্য প্রায় ৫ হাজার গানে বাজিয়েছেন। এই অবদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংগীতজগতে তিনি স্মরণীয় হয়ে উঠেছিলেন। নূরুল হক সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠোপথটার পারে দাঁড়িয়ে’, ‘কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিল না’ গানের সঙ্গে মেন্ডোলিন বাজিয়েছেন।
এন্ড্রু কিশোরের ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ গানের সঙ্গে ম্যান্ডোলিন। ‘তুমি এসেছিলে পরশু কাল কেন আসোনি’, ‘পড়ে না চোখের পলক’ গানের সঙ্গে সন্তুর বাজিয়েছেন। সুবীর নন্দী ও খুরশিদ আলমের ডুয়েট গান ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া আমি যাব’ গানের সঙ্গে সন্তুর বাজিয়েছেন।
নূরুল হকের বাবা আবদুর রহমান জব্বার বেতারে কাওয়ালি গাইতেন। বাবাই ছিলেন তাঁর ম্যান্ডোলিনের প্রথম ওস্তাদ। বাবাই কক্সবাজার থেকে ১০৭ টাকা দিয়ে তাঁকে একটি ম্যান্ডোলিন কিনে দিয়েছিলেন। এতে সুর বাঁধার পর নূরুল হক প্রথম বাজালেন ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তৈরি করার জন্য তিনি কলকাতার বহরমপুর থেকে একটি ভাঙাচোরা আমেরিকান ব্যাঞ্জো কিনে নিয়ে আসেন। এটা মেরামত করে তিনি বাজাতে শুরু করেন। তিনি আলাউদ্দিন আলীর সংগীত পরিচালনায় ‘শত জনমের স্বপ্ন’ সিনেমার গানে প্রথম সন্তুর বাজান।
তিনি সংগীত পরিচালক আলম খান, আলাউদ্দিন আলী, সুবল দাস, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, খন্দকার নূরুল আলমের সঙ্গে প্রচুর কাজ করেছেন। তিনি যে যন্ত্রগুলো বাজাতেন, এগুলো সিনেমার সংগীত পরিচালনার জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। তিনি ছায়াছবি ও অন্যান্য গান মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার গানের মিউজিক করেছেন। তিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী মেহেদী হাসান, গোলাম আলী, হৈমন্তী মুখার্জী ও সলিল চৌধুরীর সঙ্গে বাজিয়েছেন।
তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। মেয়ে আফরিন হক যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ও ছেলে ওয়ারিশ হক ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তাঁর রাজশাহীর বাড়িতেও স্টুডিও রয়েছে। এই বাড়িতেই তাঁর ছেলে, ছোট বোন, ছেলের বউ ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়।
তাঁর বোনের মেয়ে আঞ্জুমান আরা আধুনিক গান করেন। পুরো বাড়িটাই যেন একটা সংগীত পরিবার। তাঁর স্টুডিওতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর সব যন্ত্র যেন উদাস হয়ে পড়ে আছে। তাঁর ছেলে সন্তুর বের করে দেখালেন। যন্ত্রটিতে ১১০টি তার রয়েছে। ছোট বোন খালিদা হোসেন বললেন, এই স্টুডিওতে এন্ড্রু কিশোর, আলাউদ্দিন আলী, খুরশিদ আলম, ফরিদা পারভীনসহ অনেক গুণী শিল্পী এসেছেন।
স্ত্রী ফিরোজা হক বললেন, বাংলাদেশের যাঁরা বিখ্যাত শিল্পী, তাঁদের সবার গানেই তিনি বাজিয়েছেন। খুবই ব্যস্ত থাকতেন। প্রতিদিন তাঁর প্রোগ্রাম থাকত। তাঁর জীবনটাই ঢাকা শহরে ফিল্মের গানে বাজিয়ে কাটিয়েছেন। এমনও দিন গেছে, এক দিনে বারোটা গানের মিউজিক বাজিয়ে রাত একটার সময় ফিরেছেন। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়েছিল। তারপর থেকে নিয়মিত প্রোগ্রাম করতে পারেনি। পারিবারিক প্রোগ্রামে বাজিয়েছেন।
শুক্রবার বাসা থেকে বের হতে হতে মনের মধ্যে বেজে উঠল তাঁর ‘ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে’ গানের ম্যান্ডোলিনের সুর।