মুস্তাফা জামান আব্বাসী। ফাইল ছবি
মুস্তাফা জামান আব্বাসী। ফাইল ছবি

দাদির নামে ‘হীরামন মঞ্জিল’, কেমন ছিল মুস্তাফা জামান আব্বাসীর ছেলেবেলা

আজ মারা গেছেন সংগীতশিল্পী, গবেষক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী। গান, লেখালেখি আর গবেষণা নিয়ে বর্ণিল এক জীবন কাটিয়েছেন তিনি। প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’র প্রচ্ছদে উঠেছিল বরেণ্য এই সংগীত ব্যক্তিত্বের জীবনের নানা জানা–অজানা তথ্য। সেখান থেকে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো তাঁর ছেলেবেলার গল্প।

সত্যি বলতে, গান মিশে আছে তাঁর রক্তের মধ্যে। এই গান শোনা আর গান গাওয়া চলে আসছে সেই ছোট্টবেলা থেকে। আব্বাসী বলেন, কুচবিহারে তাঁর বাবা আব্বাসউদ্দীন এমন এক পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন, যেখানে ধানখেতের আলের মধ্যে সুর ঘুরে বেড়াত। সেই সংগীতকে তিনি মাঠ থেকে তুলে এনে শহরের মানুষের দোরগোড়া অবধি পৌঁছে দিয়েছেন। ভারতবর্ষে তো বটেই, এমনকি বিশ্বদরবারেও বাংলা গানকে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। কুচবিহার থেকে পরে আব্বাসউদ্দীন কলকাতায় ৬ নম্বর বেনেপুকুর লেনে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। সেখানে তাঁকে ঘিরেই সংগীতের বিশাল এক পরিসর সৃষ্টি হতে থাকে। শুধু লোকসংগীত নয়, নজরুল ইসলামের ইসলামি গানকে তিনি সবার কাছে নিয়ে যান। নজরুলের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞও ছিলেন তিনি। তিনি বলতেন, ‘আমার শরীরের প্রতি লোমকূপ নজরুলের কাছে ঋণী।’

মুস্তাফা জামান আব্বাসী। সংগৃহীত

সাতচল্লিশে দেশভাগের পর ঢাকায় এসে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে থাকেন আব্বাসউদ্দীন এবং পরিবার। আব্বাসী বলেন, ‘দাদির নামে বাবা পল্টনে “হীরামন মঞ্জিল” নামে একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বাবা ঢাকায় এসে খুব একটা ভালো ছিলেন না। কারণ, এখানে তাঁর সেই কদর ছিল না। তা ছাড়া কলকাতা তখন ছিল সারা ভারতের সংগীতের রাজধানী।’

কলকাতায় তাঁদের বাড়িতে সব সময় কবি গোলাম মোস্তফা, কবি জসীমউদ্‌দীন, আসাদউদ্দৌলা শিরাজী, কবি তালিম হোসেন, বেদার উদ্দীন আহমদ, সোহরাব হোসেনসহ আরও অনেক কবি-শিল্পী যেতেন। পুরো পরিবারটি ঢাকায় চলে আসার পর এখানেও বসত শিল্প-সংস্কৃতির আড্ডা। আব্বাসী বলেন, ‘নববর্ষের প্রথম দিনে আমাদের বাসায় গানের জলসা বসত। আমার আব্বা চমত্কার কবিতা আবৃত্তি করতেন। আমরা ভাইবোনেরা গান গাইতাম।’ এখনো পয়লা বৈশাখে সে গানগুলো তাঁর স্মৃতিতে চলে আসে। কবি সুফিয়া কামাল, ইব্রাহীম খাঁ, আবদুল লতিফ, আবদুল হালিম চৌধুরী, নাজির আহমদ, আবদুল আহাদ, ফতেহ লোহানী, জাহানারা আরজু, শামসুর রাহমান প্রমুখ পল্টনের বাসায় আসতেন। অনেক বড় ওস্তাদের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন বাসাতেই।

কুচবিহার থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকা। কত স্মৃতি, কত কথা। কিন্তু ঢাকাকে ঘিরেই মুস্তাফা জামানের সবচেয়ে বেশি স্মৃতি। তখনকার নামকরা স্কুল সেন্ট গ্রেগরিজে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। বন্ধুরা মিলে তখন কত মজার ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। সেসব আজও তাঁকে নস্টালজিয়ায় ভোগায়। স্কুলে খুব ভালো ছাত্র ছিলেন আব্বাসী। লেখাপড়ায় বরাবরই ছিলেন ফার্স্ট।

মুস্তাফা জামান আব্বাসী

আব্বাসউদ্দীন লোকসংগীত গাইলেও তিনি চেয়েছিলেন সন্তানেরা হিন্দুস্তানি সংগীতে দক্ষতা অর্জন করুক। তাই তিনি কলকাতার বাসায় নিয়ে এসেছিলেন ভারতবর্ষের বিখ্যাত ওস্তাদ জমির উদ্দীন খাঁ সাহেবের ভাইয়ের ছেলে কাদের জামিরিকে। সেটা ১৯৪৫ সালের কথা। তাঁর কাছেই দুই ভাই–বোন মুস্তাফা জামান ও ফেরদৌসী রহমানের হাতেখড়ি। তখন তাঁর বয়স সাত আর ফেরদৌসীর সাড়ে চার। প্রথম রাগটি ছিল ভূপালি। ওস্তাদ কাদের জামিরি ১৯৫০ সালে ঢাকায় চলে আসেন। বেনেপুকুর লেনের ১১ নম্বর বাড়িতে থাকতেন ওস্তাদ মুহম্মদ হোসেন খসরু। কিছুদিন পর তাঁর কাছেও দুই ভাই–বোন সংগীতে তালিম নেওয়া শুরু করেন। আর বাবার কাছে তো শিখতে হতোই।
কলকাতায় সেই কবে তাঁর রেকর্ড বেরিয়েছিল। সেগুলো চলেছিলও বেশ। বাংলাদেশে দেবু ভট্টাচার্যের সুরে আধুনিক গান গেয়েছেন। ১৯৬০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে অন্তত এক ডজন ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন। তিনি হিন্দি ও উর্দু গানও গেয়েছেন। গজলও গেয়েছেন। ভারতবর্ষের গজলের কিংবদন্তি মেহেদি হাসানের সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক ছিল। এয়ারফোর্সের অত্যন্ত নিম্নমানের চাকুরে ছিলেন মেহেদি হাসান। কিন্তু গানের গলাটা ছিল অপূর্ব। পাকিস্তানে কর্মরত অবস্থায় উভয়ের দেখা হয়। মেহেদি হাসানকে তখন কেউ চিনতেন না। সেখানে মেহেদি হাসানকে ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত শেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন আব্বাসী। আব্বাসী বলেন, ‘আজও যখন সেই শিল্পীর গান শুনি তখন মনে হয়, এই তো আমার বন্ধুর গান শুনছি।’

গানকে কখনো পেশা হিসেবে নেননি তিনি। দেশের অনেকেই হয়তো জানেন না, আব্বাসী আসলে একজন সফল ব্যবসায়ী। মতিঝিলে তাঁর অফিস। অবশ্য প্রথম জীবনে তিনি পাকিস্তানের একটি বড় কোম্পানির বড় কর্তার চাকরি পেয়েছিলেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাঁকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদটি দেওয়া হয়। তিনি তা গ্রহণও করেন।

কিন্তু মাত্র ৯ মাস পর আবার তাঁকে সরে আসতে হয় পদটি থেকে। বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের দায়িত্বও তিনি পালন করেছিলেন একটা সময়। বাংলাদেশ টেলিভিশনের লোকসংগীতের অনুষ্ঠান ‘বাঁশরী’ ও ‘হিজলতমাল’–এ ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে গান করেছেন। তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রচুর মানুষের চিঠি পান। কিন্তু এর একটিও নষ্ট করেন না। প্রতিটি চিঠিই তাঁর কাছে ভীষণ মূল্যবান। কত রকমের হাতের লেখা। ছোট ছোট অনুভূতির প্রকাশ থাকে এসব চিঠিতে। তাঁর জীবনের অনেক বড় সঞ্চয় এ চিঠি।