
একটি গান দিয়েই বদলে গিয়েছিল সবকিছু। ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’—এই গানেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসেন আসিফ আকবর। আসছে নতুন বছরের ৩০ জানুয়ারি এই সাড়াজাগানো গানের ২৫ বছর পূর্তি, রজতজয়ন্তী। দুই যুগের বেশি সময় পেরিয়েও গানটি এখনো বাংলা গানের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়।
২০০১ সালের ৩০ জানুয়ারি সাউন্ডটেকের ব্যানারে মুক্তি পায় ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ অ্যালবাম। এতে ছিল ১২টি গান। প্রকাশের পরপরই গানটি ছড়িয়ে পড়ে পাড়া-মহল্লা থেকে শহরের অলিগলি পর্যন্ত। তখন আসিফ ছিলেন নবাগত শিল্পী। কিন্তু এই একটি অ্যালবামেই তিনি রীতিমতো তারকাখ্যাতি পেয়ে যান। তরুণ প্রজন্মের আবেগ, বিরহ আর ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ওঠে তাঁর কণ্ঠ। অ্যালবাম বিক্রির দিক থেকেও সে সময় রেকর্ড গড়ে ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গানটির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে প্রবাসী বাংলাভাষীদের মধ্যেও।
সম্প্রতি মাছরাঙা টেলিভিশনের ‘বিহাইন্ড দ্য ফেইম উইথ আরআরকে’ অনুষ্ঠানে গানটি নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন আসিফ আকবর। তিনি জানান, অ্যালবামটি ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত হলেও টেলিভিশনে গানটি প্রচার শুরু হয় জুলাই মাসে। শুরুতে প্রতিক্রিয়া ধীরে এলেও টিভিতে প্রচারের পর গানটির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। নিজের পথচলা নিয়ে আসিফ বলেন, ‘আমার কোনো কাজ সহজে হয়নি। ঝড়, বন্যা, অভাব, পারিবারিক চাপ—সবকিছুর ভেতর দিয়েই আমাকে চলতে হয়েছে। এসবের মধ্যেই থাকতে আমার ভালো লাগে।’
আসিফের এ সাফল্যের পেছনে ছিল দীর্ঘ সংগ্রামের গল্প। ১৯৯৭ সালের ১৫ অক্টোবর তিনি ঢাকায় আসেন মূলত সাউন্ড ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে। সে সময় সুরকার শওকত আলী ইমনের স্টুডিওতে নিয়মিত ডেমো ভয়েস দিতেন। সেখানেই পরিচয় হয় সংগীত পরিচালক আলী আকরাম শুভ ও পরে ইথুন বাবুর সঙ্গে। সিনেমার একটি গান গাওয়ার পরই ইথুন বাবুর নজরে পড়েন আসিফ।
এক সাক্ষাৎকারে সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে আসিফ বলেন, ‘আমি তখন মাস্টার্স পড়ি, ঢাকা-কুমিল্লা যাওয়া-আসা করি। দুই সন্তানের বাবা। ইথুন বাবু একদিন বলেছিলেন, “তোকে এমন গান দিলাম, কোনো দিন পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।” আমি বিশ্বাস করেছি।’
কিন্তু সেই বিশ্বাসের পথ সহজ ছিল না। অ্যালবাম প্রকাশের আগে হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদলায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। ঈদে অ্যালবাম বের হবে না—এ খবরে ভেঙে পড়েছিলেন আসিফ। একসময় কুমিল্লায় ফিরে যান। তবে পরে ঢাকায় ফিরে এসে ইথুন বাবুর সঙ্গে গুলিস্তান থেকে মিরপুর পর্যন্ত ফুটপাতে ফুটপাতে ঘুরে ক্যানভাসারদের হাতে অ্যালবাম তুলে দেন। নিজেরাই অনুরোধ করতেন গান বাজানোর জন্য। রাজশাহী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছেন তাঁরা। তিন মাস পর আসে ফল—গানটি সুপারহিট।
এই পথচলার মধ্যে ছিল ব্যক্তিগত কষ্টের ঘটনাও। এক রাতে কাজের মধ্যেই খবর আসে—ছোট ছেলে রুদ্র গুরুতর অসুস্থ। সেই স্মৃতি বলতে গিয়ে এক অনুষ্ঠানে কান্নায় ভেঙে পড়েন আসিফ। সেদিন ইথুন বাবুর সহানুভূতি আর সহযোগিতার কথাও স্মরণ করেন তিনি। সেই সময়ের সামান্য আর্থিক সহায়তাই ছিল তাঁর পরিবারের জন্য বড় ভরসা।
‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ অ্যালবামটি আসিফ আকবরের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর দুই যুগে প্রকাশিত হয় দুই ডজনের বেশি একক অ্যালবাম। যদিও প্রথম অ্যালবামের পর নানা কারণে ইথুন বাবুর সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হয়। দীর্ঘ বিরতির পর পাঁচ বছর আগে ‘চুপচাপ কষ্টগুলো’ গান দিয়ে আবার একসঙ্গে কাজ করেন তাঁরা। সেই সঙ্গে জানান সামনে নিয়মিত নতুন গান প্রকাশের পরিকল্পনার কথা।
২৫ বছরে এসে ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ শুধু একটি গান নয়, এটি আসিফ আকবরের সংগ্রাম, বিশ্বাস আর ফিরে দাঁড়ানোর গল্প। রজতজয়ন্তীর প্রাক্কালে সেই গল্পই যেন আবার নতুন করে ফিরে আসছে শ্রোতাদের কাছে।