ইত্যাদির মঞ্চে নির্মাতা, উপস্থাপক হানিফ সংকেত
ইত্যাদির মঞ্চে নির্মাতা, উপস্থাপক হানিফ সংকেত

এবারও সাড়া ফেলেছে স্মৃতিজাগানিয়া ঈদের ‘ইত্যাদি’

বাংলাদেশ টেলিভিশনের দুটি অনুষ্ঠান নব্বই দশকের ঈদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। হানিফ সংকেতের ‘ইত্যাদি’ আর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘আনন্দমেলা’। আনন্দমেলা সেই জৌলুশ হারিয়েছে। তবে ইত্যাদির শানশওকত এখনো রয়ে গেছে। ভালোভাবেই আছে। বললে বাড়াবাড়ি হবে না, এই একটি অনুষ্ঠানই টিকে আছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকে। ঈদ আর ইত্যাদি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।

ঈদের ছুটিতে দর্শকের মধ্যে আনন্দ মেলে ধরে ‘ইত্যাদি’। বছরের পর বছর ঈদের পরদিন ‘ইত্যাদি’ দেখার জন্য নানা বয়সের, শ্রেণি-পেশার মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। অপেক্ষা করেন কখন ইত্যাদির প্রচার শুরু হবে। কখন সেই চিরচেনা সূচনাসংগীত শুনবেন। ‘ইত্যাদি’ প্রবীণদের স্মৃতিতে যেমন দোলা দেয়, তেমনি নতুন প্রজন্মের দর্শকদের মাঝেও রয়েছে এর চাহিদা। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপের যুগেও তা-ই।

এবারের ঈদেও সাড়া ফেলেছে ইত্যাদি। ঈদের পরদিন টেলিভিশনের সামনে বসে যেমন মগ্ন হয়ে দেখেছেন অগণিত দর্শক; ইউটিউবে প্রচারের পরও হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন দর্শকেরা। বিটিভিতে ঈদের পরদিন প্রচারের পর ১ এপ্রিল ফাগুন অডিও ভিশনের ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড হয় অনুষ্ঠানটি। শুক্রবার বেলা ১১টা পর্যন্ত ইউটিউবে ৫১ লাখের বেশি ভিউ হয়েছে। ট্রেন্ডিংয়ের তালিকায় ৬ নম্বরে আছে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের অনুষ্ঠানটি। এক লাখের বেশি রিঅ্যাক্ট হয়েছে, মন্তব্য জমা হয়েছে ৫ হাজার ৫৫৫টি!

ফাগুন অডিও ভিশন প্রযোজিত ইত্যাদি রচনা, পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেছেন হানিফ সংকেত। আবারও বাজিমাত করেছেন বরেণ্য এই নির্মাতা।

ইউটিউবে ইত্যাদির নিচে মন্তব্য পড়ে একটা বিষয় পরিষ্কার, অনুষ্ঠানটি দর্শকদের স্মৃতিকাতর করে। শরফুদ্দিন নামে এক দর্শকের ভাষ্যে, ‘নব্বই দশকে যখন ইত্যাদি হতো, তখন আমার এলাকায় কারেন্ট ছিল না; ব্যাটারি ভাড়া করে নিয়ে এসে গ্রামের লোকজন এক জায়গায় বসে ইত্যাদি দেখতাম, কত যে আনন্দ লাগত!’ ওমর ফারুক লিখেছেন, ‘আমরা বুড়ো হয়ে গেলাম কিন্তু ইত্যাদি চিরসবুজ রয়ে গেল।’ তারেক সালাম জানিয়েছেন ইউটিউবে ইত্যাদি দেখার অভিজ্ঞতা, ‘ইত্যাদি দেখলে ছোটবেলাটা মনে পড়ে যায়। সেই ছোটবেলায় অপেক্ষায় থাকতাম বিটিভির সামনে বসে ইত্যাদি দেখার জন্য। বিটিভি থেকে এখন ইউটিউবে দেখছি।’ শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও এই অনুষ্ঠানের দর্শক রয়েছেন। যেমন দীপক সিনহা নামের এক দর্শক লিখেছেন, ‘আমি ভারতীয় বাঙালি, ইত্যাদি এত ভালো লাগে, বলে বোঝাতে পারব না, মনে হয় ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে এ প্রোগ্রামটি।’ পৃথিবীর নানা দেশে থাকা প্রবাসীরাও জানিয়েছেন ইত্যাদি নিয়ে ভালো লাগার কথা। অনেকে আবার মন্তব্যের ঘরে মামা–ভাগনে, নানি–নাতির অংশগুলোর রাখার পরামর্শ দেন। সবমিলে বোঝা যায়, ইত্যাদির নিয়মিত দর্শক তারা।

বিদেশিদের নিয়ে এবারের পর্বের বিষয় ছিল ‘গুজব’
আমার কাছে দর্শকের রায় চূড়ান্ত। তবে সেটা সমকালীন ভিউ বিচারে নয়। দর্শক যত দিন চাইবেন এবং যত দিন আমার অনুষ্ঠান করার সক্ষমতা থাকবে, তত দিন ইত্যাদি করে যাব।
হানিফ সংকেত

এবারের ইত্যাদির মঞ্চ ছিল বিশাল ও নান্দনিক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে মিরপুর ন্যাশনাল সুইমিং কমপ্লেক্সে প্রথমবার উন্মুক্ত স্থানে ইত্যাদির ঈদের বিশেষ পর্বের ধারণ যাত্রা শুরু হয়। পরে বেশ কয়েক বছর নিয়মিতভাবে মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামে ঈদের ইত্যাদি ধারণ করা হয়েছে।

তবে এবার বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ব্লু স্কাই গার্ডেনসংলগ্ন একটি দৃষ্টিনন্দন স্থানে ঈদের ইত্যাদি ধারণ করা হয়। গার্ডেনের লেকের সামনে বিশাল স্থানজুড়ে নান্দনিক সেট দর্শকের নজর কেড়েছে। পর্দায়ও ভালো লেগেছে দেখতে। আর শুরুটা হয়েছে যেন ঐতিহ্য মেনেই শুরু হয় অনুষ্ঠান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গানটি দিয়ে।

কী ছিল না ইত্যাদিতে? হাস্যরসাত্মক নাট্যাংশ, নাচ থেকে নতুন নতুন গান। গানে ছিল একের পর এক চমক। এই প্রথম একসঙ্গে ইত্যাদির একটি গানে কণ্ঠ দেন দুই সংগীত তারকা হাবিব ওয়াহিদ ও প্রীতম হাসান। অন্য আরেকটি গানে কণ্ঠ দেন অভিনেতা সিয়াম আহমেদ এবং ছোট পর্দার অভিনেত্রী জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি। এই দুই শিল্পী একসঙ্গে কখনো অভিনয় করেননি। ইত্যাদিতে তাঁরা একসঙ্গে গাইলেন কবির বকুলের লেখা ইমরান মাহমুদুল সুরারোপিত গানটি।

ছোটবেলা থেকে হানিফ সংকেতের মতো একজন ব্যক্তিত্বকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখে আসছি। তাঁর “ইত্যাদি” ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যেমন আমাদের এত লম্বা সময় ধরে আনন্দ দিয়ে আসছে, তেমনি তাঁর পরিচালিত নাটকও আমাদের ভালো লাগার একটি বড় কারণ। প্রতিবারই হানিফ ভাইয়ের কাছে কিছু না কিছু শিখছি। এত গোছানো কাজ করেন, যা দূর থেকে বুঝতে পারতাম না।
অভিনেতা ইরফান সাজ্জাদ
নাচে অংশগ্রহণ করেছেন টিভি অভিনেত্রী সাফা কবির, সাদিয়া আয়মান, পারসা ইভানা ও সামিরা খান মাহি

ইত্যাদির নাচ মানেই বর্ণাঢ্য আয়োজন। প্রতিবারই চেষ্টা করা হয় নাচের গান, বিষয়, চিত্রায়ণে বৈচিত্র্য আনতে। এবারের ইত্যাদিতেও একটি ভিন্ন আঙ্গিকের নাচের আয়োজন ছিল।

এই প্রথম একসঙ্গে ইত্যাদির একটি গানে কণ্ঠ দেন দুই সংগীত তারকা হাবিব ওয়াহিদ ও প্রীতম হাসান। অন্য আরেকটি গানে কণ্ঠ দেন অভিনেতা সিয়াম আহমেদ এবং ছোট পর্দার অভিনেত্রী জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি।

আর নাচটিতে অংশগ্রহণ করেছেন টিভি অভিনেত্রী সাফা কবির, সাদিয়া আয়মান, সামিরা খান মাহি ও পারসা ইভানা। নাচে, গানে শিল্পী নির্বাচনে এখানেও চমক দিয়েছেন নির্মাতা হানিফ সংকেত। এ ক্ষেত্রে একটি কথা না বললেই নয়, গানের মৌলিক উপস্থাপন। প্রতিটি গান শুধু মৌলিক নয় বরং সুর, ছন্দে নির্ভুল। কথা, সুর, গায়কিতে হানিফ সংকেত বরাবরই খুঁতখুতে, কোথাও একচুল ছাড় দেননি। হোক সেটা পেশাদার শিল্পীর গাওয়া কিংবা অভিনয়শিল্পীদের। সিয়াম, হিমির গান শুনে মনে হয়েছে তাঁরা পেশাদার কণ্ঠশিল্পীই! শিল্পীরা হানিফ সংকেতের রুচি এবং দক্ষতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় থাকেন। যেমন এবারের ঈদে হানিফ সংকেত পরিচালিত ‘ঘরের কথা ঘরেই থাক’ নাটকের অভিনেতা ইরফান সাজ্জাদ প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, ‘ছোটবেলা থেকে হানিফ সংকেতের মতো একজন ব্যক্তিত্বকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখে আসছি। তাঁর “ইত্যাদি” ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যেমন আমাদের এত লম্বা সময় ধরে আনন্দ দিয়ে আসছে, তেমনি তাঁর পরিচালিত নাটকও আমাদের ভালো লাগার একটি বড় কারণ। এই আমি এখন তাঁরই পরিচালনায় কাজ করছি! এখন পর্যন্ত তাঁর পরিচালিত তিনটি নাটকে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা হলো। প্রতিবারই হানিফ ভাইয়ের কাছে কিছু না কিছু শিখছি। এত গোছানো কাজ করেন, যা দূর থেকে বুঝতে পারতাম না। এমনভাবে তিনি স্ক্রিপ্ট তৈরি করেন, একজন অভিনয়শিল্পীর আর বাড়তি কোনো এফোর্ট দিতে হয় না। শুধু স্ক্রিপ্ট অনুসরণ করে গেলেই হয়।’

আরেকটি গানে কণ্ঠ দেন অভিনেতা সিয়াম আহমেদ এবং ছোট পর্দার অভিনেত্রী জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি

তবে অনুষ্ঠান মানে শুধু আনন্দ-বিনোদন, গানবাজনা নয়; বরং ইত্যাদির নির্মাতা সব সময় চেষ্টা করেন বিনোদনের মাধ্যমে ইতিবাচক বার্তা দিতে। এবারের ইত্যাদির প্রতিটি পর্বে তার প্রমাণ মিলেছে। অ্যানালগ দুনিয়া থেকে দাপটের সঙ্গে ডিজিটাল দুনিয়ায় প্রবেশ করা ইত্যাদি মুগ্ধ করেছে দর্শকদের। আরেক পর্বে অনলাইনকেন্দ্রিক তিনটি ভিন্ন ঘটনা সুরে সুরে তুলে ধরেছেন তিন তারকা দম্পতি। তাঁরা হলেন শহীদুজ্জামান সেলিম-রোজী সিদ্দিকী, এফ এস নাঈম-নাদিয়া আহমেদ, ইন্তেখাব দিনার-বিজরী বরকতউল্লাহ দম্পতি। মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক টানাপোড়েন নিয়ে নির্মিত আরেকটি মিউজিক্যাল ড্রামায় অভিনয় করেছেন অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবু, মোমেনা চৌধুরী, আনোয়ার শাহী ও র‌্যাপ শিল্পী মাহমুদুল হাসান। সমকালীন ও বক্তব্যধর্মী এবারের দলীয় সংগীতের বিষয় ছিল দেখার চোখ ও বিবেকের চোখ নিয়ে। এই পর্বে ছিলেন ছোট পর্দার অভিনয়শিল্পী তৌসিফ মাহবুব ও চিত্রনায়িকা শবনম বুবলী। শুধু বিনোদন নয়, প্রতিটি উপস্থাপনে ছিল অর্থবহ বার্তাও। মনে হয়েছে, এ সময়ে কথাটা বলা জরুরি।

একটি পর্বে ছিলেন তৌসিফ মাহবুব ও চিত্রনায়িকা শবনম বুবলী

নাচ-গান ও গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ইত্যাদির বিদেশিদের নিয়ে এবারের পর্বের বিষয় ছিল ‘গুজব’। একটি পরিবারের ছোট ঘটনা শুনে প্রতিবেশীরা তিল থেকে তাল বানিয়ে ছড়িয়ে দেয় সারা গ্রামে। শেষে দেখা যায়, প্রকৃত ঘটনা ভিন্ন। এ পর্বও দর্শকদের মুগ্ধ করেছে। ইউটিউবে মন্তব্যের ঘরে এই পর্বটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন অনেকে।

প্রতিবারই ইত্যাদির দর্শক নির্বাচনের প্রক্রিয়া থাকে ভিন্ন রকম। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ব্যতিক্রমী উপকরণের মাধ্যমে নির্বাচিত তিনজন দর্শকের মুখোমুখি হয়েছেন সময়ের আলোচিত অভিনেতা ‘অ্যালেন স্বপন’খ্যাত নাসির উদ্দিন খান।

শেষেও ছিল চমক। এখানেও যেন ঐতিহ্য মেনেছেন নিমাতা। ‘ও বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলাদেশ’ গান দিয়ে ইত্যাদি শেষ হয়।

সৈয়দ আব্দুল হাদী–সাবিনা ইয়াসমীন নন, তাঁদের সঙ্গে তরুণ শিল্পীদের তালিকাটাও চোখে পড়ার মতো

গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী ও সাবিনা ইয়াসমীন। দীর্ঘদিন পর সাবিনা ইয়াসমীনকে নতুন গানে পাওয়া ছিল দর্শকের কাছে বড় উপহার। শুধু সৈয়দ আব্দুল হাদী–সাবিনা ইয়াসমীন নন, তাঁদের সঙ্গে তরুণ শিল্পীদের তালিকাটাও চোখে পড়ার মতো। ছিলেন ইমরান মাহমুদুল, রাজীব, অয়ন চাকলাদার, রাশেদ, সাব্বির জামান, সিঁথি সাহা, অবন্তী সিঁথি, আতিয়া আনিসা, মালিহা তাবাসসুম খেয়া ও সানিয়া সুলতানা লিজা। গানটির কথা লিখেছেন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, সুর ও সংগীত পরিচালনা করেছেন শওকত আলী ইমন। নবীন-প্রবীণের এই সম্মিলনের পাশাপাশি আরও দুটি গান দর্শকদের মুগ্ধ করেছে।

এর আগে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইত্যাদির কান্ডারি হানিফ সংকেত বলেন, ‘আমার কাছে দর্শকের রায় চূড়ান্ত। তবে সেটা সমকালীন ভিউ বিচারে নয়। দর্শক যত দিন চাইবেন এবং যত দিন আমার অনুষ্ঠান করার সক্ষমতা থাকবে, তত দিন ইত্যাদি করে যাব।’

তবে ইত্যাদি যে দর্শকের মন জাগানোর পাশাপাশি জোগাতেও পারছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাড়া দেখে তার প্রমাণ মেলে। প্রতি মিনিটে হু হু করে বাড়ছে ভিউ। রিলস, শর্ট ভিডিওতে ভরে গেছে ফেসবুক, টিকটক।