
মুরগি আগে না ডিম? এই প্রশ্ন শোনেনি, এমন কোনো মুরগি কিংবা ডিমখেকো মানবসন্তান পৃথিবীতে আছে কি না, তা বলা মুশকিল। তবে আমাদের এলাকায় আছেন সমশের ভাই। নামটা সমশের বলেই হয়তো তাঁর মধ্যে সবজান্তা ভাবটা প্রকট। এমন কোনো বিষয় নেই, যার উত্তর তিনি জানেন না। বলতে গেলে, গুগলের ভাই। গুগলের সঙ্গে সমশের ভাইয়ের একটাই তফাত। গুগলের তথ্য যাচাই করার সুযোগ থাকে, ভাইয়ের তথ্য মেনে নিয়ে চলে আসতে হয়।
তো মাথায় যখন প্রাচীন প্রশ্নটা উঁকি দিয়েই ফেলেছে, তখন সমশের ভাইয়ের কাছে না গিয়ে উপায় কী? দেখি, ভাইয়ের জবাবটা কেমন হয়। এই ভেবে এলাকার ছেলেপুলেদের নিয়ে গেলাম সমশের ভাইয়ের কাছে। সমশের ভাই সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে হাতিরঝিলের পাড়ে বসে ছিলেন উদাস ভঙ্গিতে। তাঁকে ঘিরে বসলাম আমরা। সমশের ভাই সবার দিকে একবার তাকিয়ে মৃদু গলায় বললেন, ‘কী ব্যাপার? কোনো প্রশ্ন ছিল?’
: জি ভাই, একটা সুরাহা দরকার।
: কিসের সুরাহা?
: সবাই বলে, ডিম আগে না মুরগি আগে? এই প্রশ্নের আসল উত্তরটা জানতে চাই।
: তার আগে ডাবল ডিমের মোগলাই খাওয়ানোর কথা দিতে হবে।
‘অবশ্যই ভাই। এক্ষুনি আনাচ্ছি।’ এই বলে আমি মোজাব্বিরকে বললাম, ‘ফুডআন্ডায় একটা অর্ডার দে তো।’ তারপর ভাইয়ের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললাম, ‘ভাই, আপনি বলেন।’
: শোনো তাহলে। মুরগি যে জায়গায় ডিম পাড়ে, মানে যেখানে বসে ডিম পাড়ে...
: জি, ভাই। যেখানে বসে ডিম পাড়ে...
: তো সেখানে ডিমটা পাড়ার পর মুরগি যদি উঠে সামনের দিকে হাঁটা দেয়, তাহলে মুরগি আগে। আর পেছনের দিকে হাঁটা দিলে ডিম আগে। সোজা হিসাব।
এত সহজ এবং দ্রুত উত্তরে সবাই একযোগে হাততালি দিয়ে বাহবা জানালাম। এই না হলেন সবজান্তা সমশের ভাই!
সমশের ভাইয়ের সমাধানের কথা উঠল বলে মনে পড়ল অফিসে বিকেলের নাশতা সমস্যা সমাধানের প্রসঙ্গটা। অফিসের আশপাশে বেশির ভাগই ভাজাপোড়ার দোকান। তেলেভাজা খাবারগুলো খেলে অশান্তি লাগে। তাই বিকল্প খাবারের খোঁজ করতে করতে একদিন ভাবলাম, সেদ্ধ ডিম খেলে কেমন হয়? অফিসের কাছেই এক খালা ডিম-চিতইয়ের পাশাপাশি সেদ্ধ ডিমও বেচেন। দুই সহকর্মীকে নিয়ে প্রথমবার খালার দোকানে ডিম খেতে গিয়ে বললাম, ‘খালা, ভালো দেখে তিনটা রিমান্ডের নাশতা দেন।’
খালা ডানে-বাঁয়ে তাকান। বিষয়টা বোঝেন না। সহকর্মীদের মুখে মিটিমিটি হাসি। তারা এই নামের সঙ্গে পরিচিত।
খালা প্রশ্ন করেন, ‘কিসের নাশতা?’
: রিমান্ডের নাশতা।
: এইডা বাজান বেচি না।
: অবশ্যই বেচেন। ওই তো আপনার হাঁড়ির ভেতরেই আছে।
: এগুলা তো বাজান সিদ্ধ ডিম।
: ওই তো খালা, এটাই রিমান্ডের নাশতা।
তারপর থেকে খালা আমাদের রিমান্ডের নাশতার সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেলেন এবং আমরাও রোজ বিকেলে তাঁর হাতের রিমান্ডের নাশতা খেয়ে পেট ঠান্ডা করলাম।
ডিম নিয়ে এই ঘোড়ার ডিমের লেখা প্রসব করার কারণ নিশ্চয়ই আপনার কাছে পরিষ্কার। এটা পরিষ্কার হলে মাথাপিছু ডিমের হিসাবটা বুঝতেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ব্যাপারটা খুলে বলি। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, সংক্ষেপে ফাও, জানিয়েছে, ২০১৮ সালে আমরা, অর্থাৎ পুরো পৃথিবীর ৭৬৩ কোটি মানুষ মিলে সাবাড় করেছি ৭ কোটি ৬৮ লাখ টন ডিম। সে হিসাবে আমরা বছরে খেয়েছি মাথাপিছু ১৬১টি ডিম। ৩৬৫ দিনে ১৬১টি ডিমের হিসাবটা বাংলাদেশের ব্যাচেলরদের জন্য ডাহা ভুল। কারণ, ডিম ব্যাচেলরের জাতীয় খাবার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় রোজ ডিম খেতে খেতে ডিমাসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। একদিন মায়ের আদরে গৃহপালিত এক বন্ধু এই মেসপালিত আমার কাছে জানতে চাইল, ‘সকালে কী খেলি?’
: ডিম পোচ আর পরোটা।
: দুপুরে কী খাবি?
: ডিমভাজি, ডাল আর ভাত।
: বিকেলে কী খাবি?
: ডিম সেদ্ধ আর চা।
: আর রাতে?
: ধুর বেটা! সারা দিন খেতেই থাকব নাকি? রাতে ঘুমাব।
ঘুম ভাঙলেই পত্রিকা নিয়ে বসি। সেদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় ডিমের ছবি দেখে বুঝলাম, ডিম এখন ভিআইপি। তার দামের নাগাল আর সাধ্যের মধ্যে থাকছে না। দাম বেড়ে গেলে মাসের খরচ ঠিকঠাক রাখতে একটু বুদ্ধি করে বাজার করার চেষ্টা করি। জানেনই তো, একটু চালাক না হলে টিকে থাকাই কঠিন। তো সেদিন বিকেলে বাজারে ডিমের আড়তের সামনে দাঁড়িয়ে দোকানদারকে বললাম, ‘ভাই, ডিম কত করে?’
দোকানদার ডিম সাজাতে সাজাতে বললেন, ‘ভালোগুলা দেড় শ টাকা ডজন আর ভাঙাগুলা এক শ।’
আমি কিছুক্ষণ মাথাটাথা চুলকে বললাম, ‘ভালো দেখে দুই ডজন ডিম ভেঙে দেন দেখি।’
দোকানদার ডিম সাজাতে গিয়ে থেমে গেলেন। এমন একদৃষ্টে আমার দিকে তাকালেন যে মনে হলো, আর কয়েক সেকেন্ড সেখানে অবস্থান করলে আমার দিকে পচা ডিম ছুড়ে মারবেন! ভাবলাম, মারুক না, এই বাজারে পচা ডিমও তো মহার্ঘ্য! কেউ সেটা মুখে ছুড়ে মারলে ফুলচন্দন হিসেবেই না হয় ধরে নেব!