ইতিহাসের এই দিনে

বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ড

বেনজির ভুট্টো (১৯৫৩–২০০৭)
ছবি: এএফপি

মুসলিম বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। তিনি পাকিস্তানের পুরুষশাসিত রাজনীতিতে নিজেকে সফল নারী নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক পাকিস্তান গঠনে গৃহীত কর্মসূচির কারণে রক্ষণশীল গোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পেলেও তিনি পিছু হটে যাননি।

বেনজির ভুট্টোর জন্ম ১৯৫৩ সালের ২১ জুন, করাচিতে এক জমিদার পরিবারে। হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন তিনি। তাঁর বাবা জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হলে বেনজির ভুট্টো দেশে ফিরে আসেন। প্রতিপক্ষের এক নেতাকে খুনের অভিযোগে ১৯৭৯ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে বেনজির ভুট্টো মাত্র ২৬ বছর বয়সে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

বেনজির ভুট্টো তাঁর বাবাকে উৎখাতকারী সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর জন্য বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হন। তিনি মূলত ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন। ১৯৮৪ সালে তিনি লন্ডনে চলে যান। ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে এসে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনমত গঠন করেন। ১৯৮৮ সালের আগস্টে জেনারেল জিয়াউল হক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। এর তিন মাস পর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বেনজির ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপিপি জয়ী হলে তিনি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মাত্র ২০ মাস পর সংবিধান লঙ্ঘন ও দুর্নীতির অভিযোগে রাষ্ট্রপতি তাঁকে বরখাস্ত করেন। ১৯৯৩ সালের নির্বাচনে বেনজির জয়লাভ করেন এবং দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ক্রমবর্ধমান সমস্যার মধ্যে জনসাধারণের আস্থা হারালে ১৯৯৬ সালে তাঁকে পুনরায় বরখাস্ত করা হয়।

১৯৯৭ সালের নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ ক্ষমতায় আসে। বেনজির ও তাঁর স্বামী আসিফ আলী জারদারি সুইস ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পাচার ও বিভিন্ন আর্থিক অসদাচরণের অভিযোগের মুখোমুখি হন। ১৯৯৯ সালে বেনজির নির্বাসনে থাকার সময় তাঁকে ও তাঁর স্বামীকে যথাক্রমে তিন ও পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে উচ্চ আদালত এই রায়কে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে ঘোষণা দেন।

রাষ্ট্রপতি জেনারেল পারভেজ মোশাররফ সাধারণ ক্ষমা অনুমোদন করলে বেনজির ভুট্টো দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য আট বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসন কাটিয়ে দেশে ফিরে আসেন ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে। তাঁর আগমনের দিনই একটা আত্মঘাতী হামলা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পান। এই হামলায় কমপক্ষে ১৩৬ জন নিহত ও ৪৫০ জনের বেশি আহত হন।

এই হামলার দুই মাস পরই ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেনজির ভুট্টো নিহত হন। সেদিন সন্ধ্যায় রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকত বাগে এক নির্বাচনী সমাবেশ শেষে সভাস্থল ত্যাগ করার সময় ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর তাঁর ঘাড় ও বুকে গুলি করে। ধারণা করা হয়, আততায়ী কিশোর নিরাপত্তারক্ষীদের হাত থেকে পালানোর কোনো উপায় না পেয়ে নিজের শরীরে বেঁধে রাখা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এই বোমা হামলায় মোট ২৪ জন নিহত হন, আহত হন প্রায় ৭০ জন। রাতে বেনজির ভুট্টোকে মৃত ঘোষণা করা হয় এবং পরের দিন নিজ শহর গার্দী খুদা বখশে বাবার কবরের পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

বেনজির ভুট্টোর মৃত্যুর পর তাঁর বড় সন্তান বিলাওয়াল ভুট্টো মাত্র ১৯ বছর বয়সে পিপিপির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই তরুণ নেতা তাঁর মায়ের হত্যাকাণ্ডের জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে দায়ী করেন। পিপিপি দল থেকে অভিযোগ করা হয়, প্রথম হামলার পরও সরকারপ্রধান পারভেজ মোশাররফ বেনজির ভুট্টোর নিরাপত্তায় যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় এমন হামলার ঘটনা ঘটেছে।

বেনজির ভুট্টো হত্যার ঘটনায় দেশি–বিদেশি চারটি সংস্থা তদন্ত চালায়। কিন্তু হত্যার ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করা যায়নি। পাকিস্তানের তালেবান গোষ্ঠী এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করলেও আসলে কার নির্দেশে হত্যাটি সংঘটিত হয়েছিল, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পাকিস্তান ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা তালেবান কমান্ডার বাইতুল্লাহ মেহসুদকে এই হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে। তিনি ২০০৯ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। এ ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে পাঁচজনকে অভিযুক্ত করা হলেও তাঁরা বিভিন্ন স্থানে গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। পারভেজ মোশাররফের শাসনামল শেষে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এই মামলায় পারভেজ মোশাররফ ও রাওয়ালপিন্ডির দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিন পান এবং পারভেজ মোশাররফ দেশ ছেড়ে চলে যান। ২০১৭ সালে বিশেষ সন্ত্রাসবিরোধী আদালত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। পারভেজ মোশাররফকে পলাতক ঘোষণা করে তাঁর স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি জব্দ করা হয়। প্রমাণ ধ্বংস করা ও নিরাপত্তা ভঙ্গের দায়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে তিন মাস পর হাইকোর্ট এই সাজা স্থগিত করে দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। মামলাটি এখনো লাহোর হাইকোর্টের রাওয়ালপিন্ডি বেঞ্চে বিচারাধীন।