জীবন যেমন

আকাশ আঁধার হয়ে আসে

ছবি: আবদুস সালাম

তাপমাত্রা ৩৪ অনুভবে ৪২। দাবদাহ, মাঝেমধ্যে ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না’ ধরনের বৃষ্টি। অতঃপর না বলা কথার বেদনায় গুমোট গরমে আবার প্রাণ ত্রাহি ত্রাহি। এর মধ্যে ‘আজি বরিষণ মুখরিত’ ক্ষণটা ভোর পর্যন্ত ভালোই লাগছিল। কিন্তু নীল নবঘনে জ্যৈষ্ঠ গগনে তিল ঠাঁই না থাকলেও কারও কারও জন্য কাজের তাগিদে বাড়ির বাইরে না যাওয়ার অবকাশ নেই।

যে মা–বাবারা স্কুল খোলার আন্দোলনে গতকালও গণস্বাক্ষরে শামিল হয়েছেন, তাঁরাও হয়তো আজ স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন। মোটরবাইকে ওয়াটার স্কি করতে করতে সন্তানকে পাশের গাড়ির কাদা–জল থেকে বাঁচিয়ে, সন্তানের জুতা–মোজা শুষ্ক রাখতে তাঁকে কাঁধে তুলে নিজে হাঁটুজলে নেমে স্কুলের ফটকে নামিয়ে দেওয়ার যে সকালের সঙ্গে রবিঠাকুরের বর্ষা দিনের মিল পাওয়া ভার। যে বর্ষা নিয়ে কবি লিখেছেন,

দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী,

আকাশে জল ঝরে অনিবার।

জগতে কেহ যেন নাহি আর!

উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, অগ্নি, নৈঋত—যত ভাগেই খণ্ডিত হোক আমাদের সিটি করপোরেশন, তবু কবি জসীমউদ্‌দীনের ‘আসমানী’ কবিতায় আসমানিদের ঘরের মতো আমাদের এ শহর, ‘ভেন্না পাতার ছানি’র মতো এই শহরেও একটুখানি বৃষ্টি হলেই পানি গড়িয়ে পড়বেই। সেই পানিতে আমাদের গাড়িগুলোকে উভচর মনে হয়—ডুবে, ভাসে। অফিসগামী যুবকের ‘পকেট কেটে’ রিকশাওয়ালার পোয়াবারো। ওদিকে হুড তুলে পর্দা টেনে এই ফাঁকে এই শহরে ‘প্রেমিক মিলবে, প্রেমিকার সাথে ঠিকই।’

‘আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে

ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল্-বিল্-বিল করে।

ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,

সেই জলেতে রান্না-খাওয়া আসমানীদের চলে।’

এই জলাবদ্ধ নগরে টাকি মাছ ধরতে ধরতে রহিমুদ্দিনের মেয়ে আসমানি ঢাকা শহরে রসুলপুরের স্বাদ খুঁজে পাবে। সামাজিক মাধ্যমে আশার চেয়ে আশঙ্কা, কাঁদার চেয়ে কাদা, শখের চেয়ে শোকের, বারির চেয়ে বাড়াবাড়ির ছবি। অনলাইনে বসে যাবে গামবুট আর ছাতার বিজ্ঞাপন। ছোট্টমণিদের জন্য রেইনকোট। দোকানি নামাবে ওয়াটারপ্রুফ মোবাইলের স্টক। মোবাইল সারানোর দোকান আজ রমরমা।

হঠাৎ কিছু হয়ে হঠাৎ থেমে যাওয়ার মধ্যে একটা আবেগ থাকে। মায়া থাকে। সেই আবেশে কারও বাড়িতে আজ খিচুড়ি আর বেগুনভাজা। কারও টবে টগর ফল আর বেলির ঘ্রাণ। বকুল ফুলে কারও উঠান আজকে সাদা। হঠাৎ বৃষ্টি মানেই অন্য রকম একটি দিন।

পথের বাচ্চাগুলো, শিল্পী রফিকুন নবী যাকে নাম দিয়েছিলেন টোকাই, প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলতেন পথকলি, তারা কি সুন্দর কাদাগোলায় ভাসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজে। পাড়ার মাঠে ফুটবল খেলে। ওদের মা ওদের বকে না। স্বাধীন ফেলে মা–বাবা কাজে চলে যায়। বাবা ভিজতে ভিজতে রিকশা চালান। গায়ের কাপড় ঘামে শুকায়। অ্যাপার্টমেন্টের বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাটা ঠিক ওই টোকাই শিশুর মতো সুখী হতে চায়। কবি শামসুর রাহমান যেমন লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার’।

সবাইকে প্রাক্‌–আষাঢ়ের শুভেচ্ছা। বর্ষা এল বলে।