আদিবাসী: পরিচয় ও স্বশাসনের অধিকার

বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে, সাধারণ আইন ও নীতিমালায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এবং স্বল্পমাত্রায় হলেও আদিবাসীদের কথা উল্লেখ রয়েছে। আমি নিজেও অন্যদের সঙ্গে মিলে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির পক্ষে কাজ করেছি। ২০১১ সালে আদিবাসী সাংসদদের অনুরোধে একটি সংস্কার প্রস্তাব কমিটিরও নেতৃত্ব দিয়েছি (এই কমিটির প্রণীত সুপারিশের কিঞ্চিৎ অংশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে স্থান পেয়েছে)। এই অবস্থান থেকে আমি সরে দাঁড়াইনি...

­পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-উত্তর আইনগুচ্ছ এবং ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনে পার্বত্যবাসীর ভূমি অধিকার সংরক্ষণে আইনি ভিত্তি বিদ্যমান রয়েছে। তবে ২০০১ সালের ভূমি কমিশন আইনের যে ধারাগুলো পার্বত্য চুক্তির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, সেগুলো আঞ্চলিক পরিষদের পরামর্শক্রমে সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি এখনো সরকার রক্ষা করেনি। এ রকম সংশোধন ব্যতীত এই কমিশন আগের কমিশনসমূহের মতো বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যতিরেকে মেয়াদোত্তীর্ণ হতে পারে। কমিশনের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে আমি এই আইন সংশোধনের আবশ্যকতার কথা তুলে ধরেছিলাম

ছবি: নিরব চৌধুরী

আদিবাসী পরিচয়ে বাগ্বিতণ্ডা
বাংলাদেশের আদিবাসী দাবিদার নাগরিকেরা কী নামে অভিহিত হবে তা নিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়ানো হয়েছে। আদিবাসী অধিকারের প্রশ্নে সাংবিধানিক ও অন্যান্য আইনে তাদের বিবরণের ধরন প্রাসঙ্গিক বটে। তবে সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি এত অধিক মাত্রায় গুরুত্ব পাচ্ছে যে আদিবাসী অধিকারের আসল অবস্থানের বিষয়টি ঢাকা পড়ে রয়েছে। সাংবিধানিকভাবে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃত হলেই যে আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্যের অবসান ঘটবে, এই ধারণাও পরিপূর্ণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে বর্ণবাদবিরোধী বিধানাবলি থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণাঙ্গদের সম-অধিকার চর্চার পরিবেশ আনতে (সুপ্রতিষ্ঠিত করতে নয়) শত বছর লেগেছে।
বাংলাদেশের নারী অধিকারের বিষয়টিও অনুরূপ। তাই এ লেখায় আমি সাংবিধানিক ইস্যু ব্যতীত বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকারের প্রশ্নে কিছু মতামত ব্যক্ত করছি। আগেই বলে রাখি, অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট জাতিসত্তাদের বেলায় ‘আদিবাসী’ পরিচয় প্রশ্নাতীত।

বর্তমান আইনের প্রেক্ষাপটে আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠা
বর্তমানে বাংলাদেশের সংবিধানে, সাধারণ আইন ও নীতিমালায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এবং স্বল্পমাত্রায় হলেও আদিবাসীদের কথা উল্লেখ রয়েছে। আমি নিজেও অন্যদের সঙ্গে মিলে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির পক্ষে কাজ করেছি। ২০১১ সালে আদিবাসী সাংসদদের অনুরোধে একটি সংস্কার প্রস্তাব কমিটিরও নেতৃত্ব দিয়েছি (এই কমিটির প্রণীত সুপারিশের কিঞ্চিৎ অংশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে স্থান পেয়েছে)।
এই অবস্থান থেকে আমি সরে দাঁড়াইনি। তবে, বর্তমান আইন ও বাংলাদেশ কর্তৃক অনুমোদিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি ও সরকারি নীতিমালা (যেমন: ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি) ইত্যাদির অধীনে আদিবাসী অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে সংশ্লিষ্ট সবারই অন্যায় আচরণ হচ্ছে। এই লেখায় তাই আমি এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি, যার মধ্যে রয়েছে আদিবাসী পরিচয় ও স্বকীয়তা, সংস্কৃতি, ভাষা, ভূমি ও স্বশাসনের অধিকার।

পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক স্বশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ প্রশাসনিক কাঠামোতে সীমিতভাবে হলেও আঞ্চলিক স্বশাসনের স্বীকৃতি রয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও প্রথাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের (রাজা বা সার্কেল চিফ, মৌজা হেডম্যান ও গ্রামের কার্বারি) প্রশাসনিক ভূমিকার কারণে। তবে সরকার কর্তৃক ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের অবহেলার কারণে এই প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালিত হচ্ছে না। সরকার ছাড়া অন্যদেরও এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব রয়েছে।
জেলা পরিষদসমূহের প্রশাসনিক আদেশ ও প্রবিধানের মাধ্যমে পরিষদসমূহের ভূমিকা বৃদ্ধির সুযোগ অবহেলিত রয়ে গেছে। স্ব-উদ্যোগে প্রথাগত প্রতিষ্ঠানসমূহের দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অনেক কাজ বাকি রয়েছে।
আঞ্চলিক পরিষদের ভূমিকা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অনুরূপ স্থবিরতা পরিলক্ষিত।

সমতল অঞ্চলে আদিবাসীদের স্বশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা
স্বশাসনের ক্ষেত্রে সমতলের আদিবাসীদের ভূমিকা আইনানুগভাবে স্বীকৃত নয়। স্থানীয় সরকারকাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে এ অবস্থার উন্নতি করা যায়। এ ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এম এম শওকত আলী কর্তৃক ২০০৬-০৭ সালে সরকারের কাছে পেশকৃত প্রতিবেদনে সমতলের ইউনিয়ন পরিষদে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রাখার প্রস্তাব অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নির্দলীয় সরকার অথবা তৎপরবর্তী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার এই সুপারিশ অগ্রাহ্য করেছে। উপজেলা পরিষদের ক্ষেত্রেও অনুরূপ সংস্কার আনা যায়। অতি দ্রুতগতিতে বাঙালি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সব মেয়রই বাঙালি। উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদেও অনুরূপ ধারা দেখা যাচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে সংসদেও একই অবস্থা বিরাজ করাটা অবশ্যম্ভাবী। আগে বিশেষ কার্যাদি বিভাগ নামে একটি মন্ত্রণালয়তুল্য বিভাগ ছিল। এই বিভাগকে পুনরুজ্জীবিত করে মন্ত্রণালয়ের মর্যাদা দিয়ে সমতলের আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায়। তবে সব ক্ষেত্রে নারীদের সমভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-উত্তর আইনগুচ্ছ এবং ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশনে পার্বত্যবাসীর ভূমি অধিকার সংরক্ষণে আইনি ভিত্তি বিদ্যমান রয়েছে। তবে ২০০১ সালের ভূমি কমিশন আইনের যে ধারাগুলো পার্বত্য চুক্তির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, সেগুলো আঞ্চলিক পরিষদের পরামর্শক্রমে সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি এখনো সরকার রক্ষা করেনি। এ রকম সংশোধন ব্যতীত এই কমিশন আগের কমিশনসমূহের মতো বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যতিরেকে মেয়াদোত্তীর্ণ হতে পারে। কমিশনের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাম্প্রতিক এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে আমি এই আইন সংশোধনের আবশ্যকতার কথা তুলে ধরেছিলাম। জমির মালিকানা হস্তান্তর, ভূমি অধিগ্রহণ, প্রথাগতভাবে ব্যবহৃত বন ও অন্যান্য ভূমির স্বত্ব সংরক্ষণ, জুমচাষ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের আইনি ক্ষমতা ১৯৯৮-এর সংশোধনী আইনে রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে পরিষদসমূহের দুর্বল ভূমিকার পেছনে কেবল সরকার দায়ী নয়, পরিষদসমূহের অবহেলাও দায়ী। পরিষদসমূহের নির্বাচন হওয়া আবশ্যক। তবে অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদে কেবল সরকারি দলের সদস্য না নিয়ে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। আঞ্চলিক পরিষদ ভূমি প্রশাসন নীতিমালা প্রণয়ন ও অন্যান্যভাবে সমন্বয় সাধন ও তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে অগ্রগতি আনতে পারে।

সমতলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার
জোরপূর্বক অথবা জাল দলিলের মাধ্যমে সমতলের আদিবাসীদের রেকর্ডকৃত জমি অন্যের কাছে বহু দশক ধরে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে ও রাখাইন অধ্যুষিত বৃহত্তর বরিশাল এলাকায়। ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনে আদিবাসীদের ভূমি অন-আদিবাসীদের কাছে হস্তান্তরের বাধানিষেধ রয়েছে, তবে তা অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর করা হয়। তাই সমতলের আদিবাসীরা পার্বত্যাঞ্চলের মতো একটি ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে। এই দাবির প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু প্রশাসনিক ও অন্যান্য জটিলতা অনুধাবন করে খুব শিগগির যে সরকার এই দাবি মানবে তা আমি মনে করি না। তাই সাম্প্রতিক অবস্থায় এই সমস্যা সমাধানকল্পে সরকার অন্যান্যের মধ্যে দুটি পদক্ষেপ নিতে পারে।
প্রথমত, ১৯৫০ সালের ভূমি আইন সংশোধন করে সরকার সংশ্লিষ্ট জেলার রাজস্ব কর্মকর্তার কাছে বেদখলকৃত জমি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব অর্পণ করতে পারে, মালিকানা হস্তান্তরের বিষয় জড়িত থাকুক বা না থাকুক। দ্বিতীয়ত, সমতলের আদিবাসীদের, এমনকি সাধারণ নাগরিকদের, কৃষিজমিসংক্রান্ত বিরোধসমূহ দ্রুত ও সুষ্ঠু নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে সরকার জেলা পর্যায়ে কর্মরত বিচারকসংবলিত বিশেষ ভূমি আদালত গঠন করতে পারে। সময় ও খরচ কমানোর জন্য এই আদালতসমূহে জটিল প্রক্রিয়াগত বিধানাবলির (কার্যবিধি ও প্রমাণসংক্রান্ত) প্রয়োগ শিথিল করা উচিত এবং আপিলের স্তর সীমিত রাখা দরকার। ফলে আইনজীবীর সহায়তা ব্যতীত মামলা নিষ্পত্তি করা যাবে। যেমনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে বিশেষ পরিসরে বিদ্যমান রয়েছে।

আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি
২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে দেশের সব নাগরিকের পরিচয় ‘বাঙালি’ হিসেবে উল্লেখ করে ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ইত্যাদি পদে ভূষিত করে সরকার আদিবাসীদের মনে গভীর আঘাত হেনেছে। তবে সংশ্লিষ্ট জাতিসত্তাসমূহের (উল্লেখ্য, সংশোধনীতে ‘জাতিসত্তা’ শব্দটি স্থান পেয়েছে) কৃষ্টি ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের বিষয়ে যে বিধানাবলি আনা হয়েছে, তাতে আদিবাসীদের নীতিগত কোনো বিরোধ থাকার কথা না। এই বিধানাবলিবলে সরকার আদিবাসীদের অংশগ্রহণ ও সম্মতি নিয়ে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি দাতা সংস্থা, ঋণদানকারী সংস্থা, এনজিও ও নাগরিক সমাজ সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। পাশ্চাত্যের অনেক দেশে সংস্কৃতি খাতে রাষ্ট্র, বেসরকারি ফাউন্ডেশন ও অন্যান্য সংগঠন বিপুল অর্থ জোগান দেয়। আমাদের দেশে এই ক্ষেত্রে কেউই এগিয়ে নেই। আদিবাসীদের প্রান্তিকতার কারণে বাজার অর্থনীতির ভূমিকা সহায়ক নয়, বরং ক্ষতিকর। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভূমিকাও ভালো ও মন্দ দুটোই হতে পারে। তাই এই প্রতিকূল অবস্থায়ও আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহের সীমিত সম্পদ দিয়ে সোচ্চার সংগ্রাম চালানো ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। এই ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ, গ্রামবাসী-নগরবাসী, সবার নিজ নিজ ভূমিকা কাম্য।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
সার্বিকভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের অবস্থান দেশের অন্য নাগরিকদের চেয়ে অনেক নিচে। মণিপুরি, চাকমা, গারো ও বম সম্প্রদায়ের মধ্যে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের হার জাতীয় গড়ের চেয়ে কিছুটা বেশি হতে পারে। তবে সম্প্রদায়গতভাবে জাতীয় সমীক্ষা ও আদমশুমারিতে পৃথক তথ্য-উপাত্ত না থাকায় তাও সঠিকভাবে বলা যায় না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংকলিত তথ্যের উদ্ধৃতি পাওয়ার আমার সুযোগ হয়েছিল, যাতে উল্লেখ রয়েছে যে চাকমা জনগোষ্ঠীর অক্ষরজ্ঞানের হার ৬০ বা ৭০ শতাংশেরও বেশি। জানতে চেয়েছি এই তথ্যের এবং অন্যান্য সম্প্রদায় যথা: ম্রো, খুমি, মুন্ডা ইত্যাদির বেলায়ও নির্দিষ্ট তথ্য আছে কি না। এ প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি। আদিবাসী সম্প্রদায়সমূহের শিক্ষার ক্ষেত্রে সঠিক অবস্থান জানা না থাকলেও সাধারণভাবে তাদের বেশির ভাগের অবস্থান যে জাতীয় গড়ের চেয়ে অনেক নিচে, তা পার্বত্যাঞ্চলের আদিবাসী অধ্যুষিত অনেক ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষার অবস্থান পর্যালোচনা করলেই অনুধাবন করা যায়।
মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় আদিবাসী শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায়, বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে, পর্যাপ্ত সংখ্যক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় অনেকেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। রাঙামাটিতে সরকার নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পক্ষে। তবে তা হওয়া উচিত পার্বত্য জনগণের সম্মতি সাপেক্ষে ও প্রয়োজনীয়তা অনুসারে। একপক্ষীয়ভাবে তা চাপিয়ে দিলে অন্যায় হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চার ভাগের এক ভাগজুড়ে তথাকথিত সংরক্ষিত বন বা রিজার্ভ ফরেস্ট। এসব এলাকায় ইউএনডিপি ও পার্বত্য জেলা পরিষদ কর্তৃক পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহের জমি সংরক্ষিত বনের আওতামুক্ত হলেও অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার পরিচালিত বিদ্যালয় সরকারীকরণ প্রক্রিয়া এখনো স্থগিত রয়েছে। কারণ, জাতীয় বননীতি অনুসারে সরকারপ্রধানের অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো সংরক্ষিত বনের জমি ডি-রিজার্ভ বা সংরক্ষিত বনের আওতামুক্ত করা যায় না। অপর দিকে ডি-রিজার্ভ না করলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বিদ্যালয়গুলোর সরকারীকরণে নারাজ।

বৈষম্যহীনভাবে সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা
আদিবাসী জাতিসত্তাসমূহের স্বকীয়তা অটুট রেখে জনমুখী উন্নয়ন করা যায়। এ ক্ষেত্রে সম্পদের অপ্রতুলতার চেয়ে অধিক বাধা আসে নীতিনির্ধারণী মহলের অসহিষ্ণু ও জাত্যভিমানী মনোভাব ও আদিবাসী জনগণের উন্নয়নস্পৃহার ব্যাপারে অজ্ঞতা ও অসংবেদনশীলতা থেকে।
২০১১ সালে সংবিধান সংস্কারের সময় সরকার আদিবাসীদের দাবি অগ্রাহ্য করেছে। সামনে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে এ ভুল আংশিকভাবে হলেও শোধরানোর সুযোগ রয়েছে। আদিবাসী নাগরিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে বৈষম্যহীনতার মৌলিক তত্ত্ব বুঝতে হবে। সবার প্রতি কেবল গাণিতিক অর্থে সম-আচরণ করলে বৈষম্য দূর হয় না, আর্থসামাজিক ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপটও আমলে নিতে হয়। ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে আদিবাসীদের পরিচয়, স্বকীয়তা, সামষ্টিক মূল্যবোধ, প্রথাগত ভূমি অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে আমলে নিতে হবে। এগুলো হলো জাতিসংঘের চার্টার, সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ ও আদিবাসীবিষয়ক ঘোষণাপত্রের মূলমন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। এগুলোর কোনোটাই সংবিধানের মৌলক অধিকারের পরিপন্থী বলে আমি মনে করি না।

দেবাশীষ ওয়াংঝা: সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী ও জাতিসংঘের আদিবাসী-বিষয়ক স্থায়ী ফোরামের সদস্য।