ঈদের লাল জামা

ছোটবেলার ঈদে লাল জামাটাই হয়ে উঠত সবার অতীব প্রত্যাশিত অনুষঙ্গ। প্রাপ্তিযোগের পর আবার সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতাও হতো, কার জামাটা কোনোটার চেয়ে বেশি সুন্দর। দুটো পকেট আছে কিনা, থাকলে ওগুলোর ওপরে ঢাকনা আছে কিনা। লালের সঙ্গে সবুজ ডোরাকাটা নাকি প্লেন সবুজের ওপর লাল ছাপ, বাটিক নাকি ফুলের ছাপ মারা, কলারগুলো লম্বা কিনা, নিচের অংশটা গোল করে কাটা নাকি ঢেউখেলানো (চাইনিজ কাট) ইত্যাদি।

ঈদের দিন সকালেই গোসল করে লাল জামা গায় দিয়ে শুরু হতো বড়দের সালাম করার প্রতিযোগিতা। অত: পর সালামির হিসাব নিকেশ শেষে সবাই সোজা ঈদগাহে। তারপর পাশের ছোট ছোট দোকানগুলোতে ভিড় লেগে যেতো সালামির টাকায় চকলেট আইসক্রিম মুড়ালি খাওয়ার ধুম। এসব মধুর স্মৃতি কখনোই জীবন থেকে মুছে যাওয়ার নয়।

বাড়ির চাচা-জেঠারা সবাইই চাকুরে, তাই শহর থেকে অনেক দিন পর ঈদের ছুটিতে বাড়ি আসছেন। দাদা, দাদি, চাচি মা, জেঠিমা সবার মধ্যেই এক ধরনের চঞ্চলতা আর আনন্দবোধ কাজ করছে। চাচাতো ভাই-বোনদের সঙ্গে আমিও হই-হল্লুড় করছি, ছোটাছুটি করছি এবং তাদের কাছে শুনে শুনে আমার মনেও লাল জামার স্বপ্নটা বড় হতে হতে প্রায় পাওয়ার মতো সাইজ হয়ে গেছে। ঈদের আগের দিনদুপুরে শহর থেকে সবাই বাড়িতে পৌঁছে গেছে। বাজারঘাট সদাইপাতি গুছানো নিয়ে সবাই ব্যস্ত। বৈঠকখানার পাশে ময়লা ধুতি পরিহিত জগবন্ধু শীল তার পুরোনো ক্ষুর-কাচি আর চিরুনি নিয়ে বসে আছে চুল কাটার জন্য। আমাদের একেকজনকে দৌড়ে ধরা হয়, তারপর সোজা জগবন্ধুর সামনে পাতা চৌকিতে বসায়ে চুল কাটা। জগবন্ধু দুই হাঁটুর মাঝে মাথা চেপে ধরে ভোঁতা সব যন্ত্রপাতি দিয়ে যখন চুল কাটতেন, তখন খুবই ব্যথা লাগে। যে কারণে জগবন্ধুর আগমনে আমরা সবাই পালিয়ে বেড়াতাম। সবার চুল কাটা শেষ হলে বয়োবৃদ্ধ জগবন্ধু বাড়ি ফিরে যেতেন, টাকা নিতেন না। শুধু ঈদে দাদার হাত থেকে বকশিশ পেতেন আর বছরে তিনবার ফসল কাটা পড়লে এসে বস্তাভরে ধান নিয়ে যেতেন।

ঈদের আগের দিন বিকেল। চুল-কাটা এবং গোসল পর্বের পরই সবাই লাল জামা দেখানোর মহড়া শুরু করেছে। এই প্রথম কোনো ঈদে বাড়ির সব শিশুর সঙ্গে আমিও অপেক্ষা করছিলাম লাল জামার জন্য। সবারটা দেখে আমিও গিয়ে আম্মাকে বললাম, লাল জামার কথা। আম্মা খড়ির চুলোয় রাতের খাবার রান্না করছিলেন। খামোখাই আমাকে চিকন একটা খড়ি নিয়ে তাড়া করলেন, ‘দাঁড়া, তোর লাল জামা দেখাইতাছি...।’ আমি এক দৌড়ে সোজা পুকুর পাড়ের বাঁশ ঝাড়ের পেছনে চলে গেলাম। ফিরে দেখলাম আম্মাকে আর দেখা যাচ্ছে না। আম্মার নিষ্ঠুর আচরণে খুবই অবাক হলাম, কষ্টও পেলাম। তারপর বাঁশ ঝাড়ের ভেতরে ঢুকে পুকুরের পানিতে এলানো একটা জাম গাছ থেকে জাম পেড়ে, নিচে এসে বসে বসে খাচ্ছি। ওখানেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তার খেয়াল নেই। ছোট কাকা যখন হাত ধরে আমাকে টেনে কাঁধে তুলছিলেন, তখন টের পেলাম যে সন্ধ্যার অন্ধকারে আমি বাঁশ ঝাড়ের ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলাম।

কাকা আমাকে ঘরে নিয়ে পাটিতে বসালেন। ইতিমধ্যে আমাকে খুঁজে না পাওয়ার খবরে সবাই মনে হয় অস্থির হয়ে এদিক সেদিক খোঁজাখুঁজি করছিলেন। কাকা-দাদি-কাকিরা সবাই আম্মাকে খুবই বকাঝকা করছিলেন আমাকে মারার জন্য। আসলে মা তো মারেননি, ভয় দেখিয়েছিলেন। আম্মা মনে হয় অন্য কারও ঘরে আমাকে খুঁজতে গিয়েছিলেন। পাওয়া গেছে শুনে, দৌড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। বুকে জড়িয়ে ধরে রাজ্যের কান্না। কিন্তু মায়ের কান্নার কারণ তখন বুঝতে পারিনি। মায়ের কান্না দেখে আমিও কাঁদছিলাম। মাকে বলল, আমার লাল জামা লাগবে না। শুনে তিনি আমাকে আরও জোড়ে বুকের সঙ্গে চেপে ধরলেন। প্রায় সারাটা রাত মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। আমাকে লাল জামা কিনে না দিতে পারার জন্য, মুক্তিযুদ্ধের পর বাবার ফিরে না আসার জন্য, মা-ছেলের এক অনিশ্চিত জীবনসংগ্রামে মুখোমুখি হওয়ার জন্য...