Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনাযুদ্ধে বিজ্ঞানী বিজন

>
ড. বিজন কুমার শীল। ছবি: সংগৃহীত
অণুজীববিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষণাগারে স্বল্প মূল্যের করোনাভাইরাস শনাক্তের কিট আবিষ্কার করে আলোচিত হয়েছেন। ড. বিজনের এমন সাফল্য এই প্রথম নয়। ১৯৯৯ সালে ছাগলের মড়ক ঠেকানোর জন্য পিপিআর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছিলেন। ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিলে সিঙ্গাপুরে ভাইরাসটি দ্রুত নির্ণয়ের পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেন তিনি।

কথা ছিল ২৪ মার্চ বিকেলে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে কথা হবে বিজন কুমার শীলের সঙ্গে। রওনা হওয়ার আগে সাড়ে চারটার দিকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, ‘এখন তো দেখা করতে পারব না, আমরা জরুরি পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি। রাতে কথা বলব।’ বললাম, রাতে দেখা করি? ছবিও তো তুলতে হবে। জবাবে জানালেন এখন কোনোটাই সম্ভব না। রাতে ফোনে কথা হবে।

জরুরি পরিস্থিতি বলি কিংবা ভয়ংকর সময়—বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণে পুরো মানবজাতিই এখন তা পার করছে। এই দুঃসময় পার হতে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে হবে। সেই যুদ্ধেরই একজন যোদ্ধা অণুজীববিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল। আমরা এরই মধ্যে জানি তাঁর নেতৃত্বে গবেষকদের একটি দল শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করার কিট তৈরিতে সফলতা পেয়েছেন। আর তা একেবারেই কম দামে দেওয়া যাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই কিট এরই মধ্যে সরকারের অনুমোদনও পেয়েছে। বিদেশ থেকে কাঁচামাল এলে চলতি সপ্তাহে এর উৎপাদন শুরু হবে।

২৪ মার্চ রাতে মুঠোফোনে কথা হয় বিজন কুমার শীলের সঙ্গে। শুরুটা করোনা শনাক্তের কিট নিয়েই। তিনি বললেন, ‘আমরা কাজ শুরু করেছিলাম গত জানুয়ারি মাসে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশে ঘটবে কি না, তা–ও তখন বোঝা যায়নি।’ তাঁরা গবেষণার কাজ শুরু করেন। বিদেশ থেকে কিট আনা, কীভাবে আসবে আর তা সহজলভ্য হবে না, এসব চিন্তা বিজন কুমার শীলের মাথায় ছিল। তাই তো স্থানীয়ভাবে তৈরির চেষ্টা।

ছেলে অর্ণব, স্ত্রী অপর্ণা রায় এবং মেয়ে অরুন্ধতীর সঙ্গে বিজন কুমার শীল

কৌশলটা আগেই জানা ছিল

শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব অ্যান্টিবডি থেকে শনাক্ত করা হয়। এই কৌশলটা বিজন কুমার শীলের জানা ছিল। ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয় বেশ কিছু দেশে। তখন সিঙ্গাপুর সরকারের পরিবেশ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন বিজন কুমার শীল। কয়েকজন গবেষকের সঙ্গে মিলে তৈরি করেন সার্স ভাইরাস শনাক্ত করার কিট। সেটার পেটেন্টে রয়েছে এই বিজ্ঞানীর নাম।

বিজন কুমার শীল বলেন, ‘সার্স শনাক্ত করার কিট তৈরির দায়িত্ব ছিল আমাদের ওপর। আমরা তিন–চারজন খুব দ্রুত সেটা তৈরি করলাম। ওই ভাইরাসের নাম ছিল সার্স করোনাভাইরাস–১। এখন যেটা মহামারিতে রূপ নিয়েছে, এটাও সার্সের মতোই। এর নাম সার্স করোনাভাইরাস–২। সার্সের সঙ্গে এই ভাইরাসের ৮২ শতাংশ মিল রয়েছে। সার্স ভাইরাস নিয়ে যেহেতু আতঙ্ক ছিল, তাই মানুষ যাতে আতঙ্কিত না হয় তাই এবার একে কোভিড–১৯ বলা হচ্ছে।’

সার্স আর এবারের করোনাভাইরাস—মানবদেহে দুটি ভাইরাসের প্রবেশপথ (রিসেপ্টর) একই। অভিজ্ঞতা যেহেতু আছে, তাই গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক বিজন কুমার শীল ও তাঁর দল দ্রুতই করোনা শনাক্তের কিট তৈরি করতে পেরেছেন। গণস্বাস্থ্য র‌্যাপিড ডট ব্লট (জি র‌্যাপিড ডট ব্লট) নামের এই কিট তৈরির দলে আরও যে কজন অণুজীববিজ্ঞানী রয়েছেন তাঁরা হলেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নিহাদ আদনান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রাশেদ জমিরউদ্দিন এবং আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী ড. আহসানুল হক। তাঁদের এই গবেষণাকাজ সমন্বয় করেন গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মহিবুল্লা খন্দকার।

যেখানে করোনাভাইরাস শনাক্ত করার একটি কিট বিদেশ থেকে আনতে গেলে খরচ পড়বে সাড়ে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা সেখানে গণস্বাস্থ্যের এই কিট ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন এই বিজ্ঞানী। বিজন কুমার শীল বললেন, ‘আমাদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী চান, যত কম দামে সম্ভব এটা হাসপাতালগুলোতে দিতে হবে। যাতে এই রোগ দ্রুত শনাক্ত করা যায়। তাই রাত–দিন খেটে আমরা এটা আরও উন্নত করার কাজ করে যাচ্ছি। কাঁচামাল এলেই আমরা ২৪ ঘণ্টা সাভারে গণস্বাস্থ্যের ল্যাবে থেকে দ্রুত বেশি সংখ্যক কিট তৈরি করব।’

বিজন কুমার শীলের তৈরি কিট দিয়ে রক্ত পরীক্ষা করে জানা যাবে সেই ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি আছে কি না। এটির টেস্ট টাইম ১৫ মিনিট। অর্থাৎ দ্রুতই জানা যাবে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন কি না। বিজন কুমার শীল ২৬ মার্চ ফোনে বললেন, ‘কিটের কাঁচামাল রওনা হয়ে গেছে। আশা করছি, ৩০–৩১ মার্চ কাঁচামাল দেশে এসে পৌঁছাবে। কাঁচামাল থেকে কিটের উপকরণ যেহেতু আমি নিজেই বানাতে পারি তাই এর মানও ভালো থাকবে। ১০০ শতাংশ সফলতার সঙ্গেই করোনাভাইরাস শনাক্ত করা যাবে।’

বিজন কুমার শীল

কৃষক পরিবারের সন্তান
‘আমি কৃষক পরিবারের ছেলে। আমার বাবা ছিলেন কৃষক। বাবার সঙ্গে মাঠেও কাজ করেছি দীর্ঘদিন।’ বললেন বিজন কুমার শীল। নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় ১৯৬১ সালে জন্ম বিজন কুমার শীলের। বাবা রসিক চন্দ্র শীল ও মা কিরণময়ী শীলের ২ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে পঞ্চম বিজন। বনপাড়ার সেন্ট যোসেফ হাইস্কুল, পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ হয়ে ভর্তি হন ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে স্নাতক হন ভেটেরিনারি সায়েন্স বিষয়ে। ফলাফল ছিল প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন অণুজীববিজ্ঞানে। কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে যান। সেখানে দ্য ইউনিভার্সিটি অব সারে থেকে ১৯৯২ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো নিয়ে (ডেভেলপমেন্ট অব মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডিজ)। সেই থেকে বিজন কুমার শীলের অণুজীববিজ্ঞান বিশেষ করে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর গবেষণা আর থেমে থাকেনি। অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে ১৪টি উদ্ভাবনের পেটেন্ট রয়েছে বিজন কুমার শীলের নামে। পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় জার্নালগুলোতে ২০টির বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে, ২০টির বেশি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন।

বিজন কুমার শীলের স্ত্রী অপর্ণা রায় একজন প্রাণী চিকিৎসক। তাঁদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।

সার্স বা করোনাই শুধু নয়

বিজন কুমার শীল তখন সাভারের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএলআরআই) কর্মরত। ১৯৯৯ সালে হঠাৎই দেশে গবাদিপশু বিশেষ করে ছাগলের মড়ক শুরু হয়। সেই সময় সেই মড়ক ঠেকাতে বিজন কুমার শীল উদ্ভাবন করেন পিপিআর ভ্যাকসিন। ডেঙ্গুজ্বর রোগ নিয়েও কাজ করেছেন। বিজন কুমার শীল বললেন, ‘২০০০ সালে দেশে যখন প্রথম ডেঙ্গু রোগ শনাক্ত হলো তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ড. মুনিরা পারভীনসহ আমরা প্রথম ডেঙ্গু নিয়ে কাজ শুরু করি।’

২০০২ সালে বিজন কুমার শীল চলে যান সিঙ্গাপুরে। সেখানে সরকারি চাকরি করেন। এরপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও কাজ করেন। পরামর্শক হিসেবেও যুক্ত অনেক দেশি–বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে। গত ১ ফেব্রুয়ারি তিনি গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে যোগ দিয়েছেন।

গবেষণা মানুষের জন্য

বিজন কুমার শীল এমন এক ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করেন যেখানে জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় প্রতিনিয়ত। তাঁদের একেকটা গবেষণা একেকটা উদ্ভাবন অসংখ্য মানুষের সরাসরি কাজে লাগে। বিজন কুমার শীল বললেন, ‘মানবজাতি যাতে উপকৃত হয়, সে জন্যই গবেষণা করে যেতে চাই। ভবিষ্যতেও একই পরিকল্পনা।’

এই মুহূর্তে বিজন কুমার শীল চাচ্ছেন যত দ্রুত সম্ভব করোনাভাইরাস শনাক্তের কিট তৈরির কাঁচামাল দেশে আসুক। তাহলে খুবই কম খরচে কিট তৈরি করে তাঁরা তা সরকারের হাতে, হাসপাতালগুলোত পৌঁছে দিতে পারবেন, যাতে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা করা যায় ভালোভাবে।