কার্ল লাগারফেল্ড বিশ্ব ফ্যাশনের এক কারিগর
বিশ্ব ফ্যাশন বললেই কিছু জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের নাম চলে আসে। ব্র্যান্ডগুলো যাঁরা দাঁড় করান, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সেরা ছিলেন কার্ল লাগারফেল্ড। ছিল বলতেই হচ্ছে, কারণ ১৯ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন ফ্যাশনের এই মহান কারিগর।
১৯৩৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কার্ল। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। প্যারিসভিত্তিক অভিজাত ব্র্যান্ড শ্যানেলের সৃজনশীল পরিচালক পদে কাজ করতেন। সেট ডিজাইন করা, অভিজাত পোশাক ও সান্ধ্য পোশাক তৈরি, ব্যাগের নিত্যনতুন ডিজাইন আর গয়নার নকশা করায় তাঁর সমকক্ষ ছিল না আর কেউ। ইতালীয় ব্র্যান্ড ফেন্দির পশমি পোশাকগুলো নকশার দিকনির্দেশনাও দিতেন তিনি। ছবি তুলতেন, শিল্পের সমঝদার ছিলেন ও ক্যারিকেচার আঁকতেন দক্ষ হাতে। আরও ভালোবাসতেন ফ্যাশনের ওপরে চলচ্চিত্র তৈরি করতে। মাথাভরা সাদা চুল, কালো রোদচশমা, আঙুলবিহীন দস্তানা আর কড়া মাড় দেওয়া উঁচু সাদা কলার তোলা কালো স্যুট—নিজের জন্য এই ফ্যাশনই নির্ধারিত করে নিয়েছিলেন কার্ল। কালে কালে এই সজ্জাই হয়ে উঠেছে তাঁর আইকনিক ইমেজ বা চিরচেনা রূপ।
দারুণ যত সৃষ্টি
বিভিন্ন ফ্যাশন উইকে শ্যানেলের জন্য চিরস্মরণীয় কিছু সেট তৈরি করে গেছেন তিনি। ২০০৬ সালে রানওয়ের মধ্যে পুঁতে দিলেন বিশাল এক টাওয়ার। তার সিঁড়ি বেয়ে ঘুরে ঘুরে সাদাকালো পোশাক পরে নামলেন মডেলরা। বছর তিন পরে টাওয়ার সরিয়ে বসালেন বাচ্চাদের খেলার মাঠের ক্যারোসেল, তাতে মুক্তো দিয়ে তৈরি খেলনা ঘোড়া আর শ্যানেলের ব্যাগের সমাহার। কার্ল কখনো র্যাম্পে ক্যাসিনো বসিয়েছেন, কখনো সুপারমার্কেট। একবার বিমানের খোলে র্যাম্প বানালেন, তো পরেরবার সাগরতলে ডুব দিলেন। ২০১৫ সালে শো শেষে সব মডেল সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে মুখে স্লোগান, হাতে প্ল্যাকার্ড হাতে নেমে পড়ল র্যাম্পে, পুরোধা ছিলেন কার্ল। সবচেয়ে সাড়া জাগিয়েছিলেন এই বছরেই, হোটেলের ভেতরেই তৈরি করেছিলেন সমুদ্র। মডেলরা জুতো হাতে, হেসেখেলে হেঁটে বেড়িয়েছেন ঘরোয়া সমুদ্রসৈকতে।
ফ্যাশনে দৃঢ়তা
সাদাকালো রং, প্যাস্টেল রঙের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল লাগারফেল্ডের। চলতি ধারা মেনে চলতেন। শেষ র্যাম্পে লেগোর ছাঁটে তৈরি টপ ও জিনস এনেছিলেন। পোশাকে জ্যামিতিক রেখা ও পাইপিং খুব পছন্দ করতেন। ভবিষ্যতের পোশাক নিয়ে ভাবতেন, পুনরায় উৎপাদন করা যায় এমন প্লাস্টিকের পোশাক বানিয়েছিলেন। গোলাপি র্যাফেল মোড়ানো সেই গোলাপি গাউনটি আরও অনেক দিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে মানুষের মনে। টুইডকে জ্যাকেট থেকে বের করে নতুন রূপ দিয়েছিলেন ব্যাগ, জিনস এবং পোশাকে ব্যবহার করার মাধ্যমে।
অনুষঙ্গের সাধনা
পোশাকের সঙ্গে অনুষঙ্গ মেলাতে ভারী পছন্দ করতেন কার্ল। আজকাল যে চেইনযুক্ত ব্যাগ দেখি হাতে হাতে, তার আধুনিক নকশা কার্লের হাতে করা। মুক্তোর মালার সঙ্গে মানানসই স্ট্রিং বসিয়ে তাতে যেকোনো পোশাকের সঙ্গে মানানসই করার ভাবনার জনক তিনি। ডেভিল অয়্যারস প্রাডা সিনেমায় অ্যানা হাতওয়ের গলায় ঝোলা মুক্তোর মালাটি তাঁর সম্মানেই পরানো হয়েছিল। শ্যানেলের লোগোটিকে গয়নায় রূপ দেওয়ার সাহসটিও তিনিই প্রথম করেছিলেন।
কার্লের স্মরণে
৫৪ বছর ধরে ইতালীয় ব্র্যান্ড ফেন্দির সঙ্গে কাজ করেছেন কার্ল লাগারফেল্ড। মিলান ফ্যাশন উইকে রানওয়ের পুরোটা সময় জুড়ে ফেন্দি স্মরণ করল কার্ল লাগারফেল্ডকে। প্রথম পনেরো মিনিটজুড়ে প্রদর্শিত হয়েছে কার্লের ডিজাইন করা পোশাকগুলো, পরের সময়জুড়ে ছিল কার্লের পছন্দের ফ্যাশন ও ডিজাইনের অনুপ্রেরণায় তৈরি পোশাকসমূহ। রানওয়ের কার্পেটজুড়ে ছিল কার্লের উদ্ভাবিত ক্যালিগ্রাফির মনোগ্রাম। সবশেষে একা রানওয়েতে হাঁটলেন ফেন্দির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, সিলভিয়া ফেন্দি, যাঁর সঙ্গে কার্লের সখ্য ছিল বহুকালের। ফ্যাশন শো এমন শোকাবহও হতে হয়!
গ্রন্থনা: খাদিজা ফাল্গুনী
তথ্যসূত্র: গার্ডিয়ান, ভোগ, ইটি, স্ট্যান্ডার্ড, ইনডিপেনডেন্ট, নায়লন ও স্পটেড ফ্যাশন