কে বলে গো নেই আমি

শামসুর রাহমান [২৩ অক্টোবর ১৯২৯-১৭ আগস্ট ২০০৬], ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
শামসুর রাহমান [২৩ অক্টোবর ১৯২৯-১৭ আগস্ট ২০০৬], ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

২৩ অক্টোবর ছিল কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিন। কবির স্মরণ নিলেন নাসির আলী মামুন
‘আমাকে মনে না রাখলে ক্ষতি নেই, আমার কবিতাকে ভুলে যেও না।’— ২০০০ সালের ১০ অক্টোবর কবি শামসুর রাহমান তাঁর ব্যবহূত প্রিয় ফতুয়াতে এই দুই লাইন লিখে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। ব্যাংকক থেকে তাঁর এক ভক্ত ফতুয়াটি তাঁকে এনে দিয়েছিলেন। সাদায় সোনালি মেশানো জমিনে দুই জায়গায় স্বাক্ষর করে এঁকেছিলেন ছবি—আহত বিপর্যস্ত একটি বেগুনি রঙা বক। ‘হায় মুমূর্ষু বক, তোমাকে দেখলে মায়া লাগে। তুমি যেন ক্লান্ত বিধ্বস্ত মায়াবী কোনো এক প্রজাতি।’—দুই লাইনে আমাদের প্রিয় কবি শামসুর রাহমান বলে গেলেন তাঁর সবকিছু।
কয়েক দিন আগে বহু দিন অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা শামসুর রাহমানের হস্তাক্ষরযুক্ত সেই পরিধানটি বের করি। ঝাড়া দিয়ে ফতুয়াটা লাল হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে দিই পরম যত্নে। বাড়ির ছাদে কয়েক ঘণ্টা রৌদ্রযাপনের পর গোধূলি লগ্নে যখন সেটি আনতে গেলাম, সেই মুমূর্ষু বকটি আবার যেন বেদনায় সংক্রমিত করল আমাকে। পাখিটি যেন শার্ট থেকে উড়ে উধাও হয়ে যাবে গোধূলির নিলাকাশে আর কবি প্রবেশ করবেন শার্টের ভেতর!

কবির তোলা প্রেয়সী স্ত্রীর ছবি: সঙ্গে চিঠি। যেখানে কবি লিখেছেন তাঁর সেই ছবি তোলার স্মৃতিকথা


পৃথিবীর বহু খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের এমন সব স্মৃতিচিহ্ন আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে জমা করে রেখেছি। মাঝেমধ্যে সেসব দেখি, আর আমি নিজে নিজেই বিস্মিত হই! কবে যে কী খেয়ালে সংগ্রহ করেছিলাম এসব! তবে এই স্মৃতিগুলো মাঝেমধ্যেই এখন আক্রমণ করে আমাকে। তাঁদের হাতের লেখা, আঁকা চিত্রকর্ম, ভিডিওচিত্র, রেকর্ডকৃত কথোপকথন, আমার তোলা পোর্ট্রেট, ব্যবহূত জিনিসপত্র আরও কত কী—সবকিছুকে যথোপযুক্ত লালনপালনের জন্য দরকার একটি স্থায়ী সংগ্রহশালা।
সম্প্রতি ‘ফটোজিয়াম’ নামে একটি জাদুঘর গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছি। শামসুর রাহমানের মতো যাঁরা আমাদের এক একটি বাতিঘর, তাঁদের সচিত্র বাসস্থান হবে ফটোজিয়াম। আগামী প্রজন্ম এখানে এসে মমতাভরে দেখবে নিজেদের সভ্যতার ধারক-বাহকদের।

এই চশমা দিয়ে কবি দেখতেন তাঁর চারপাশ—ঘরবাড়ি, প্রকৃতি ও প্রিয়জনদের

বহু বছর আগে একবার হঠাৎ আমার মনে হলো, যাঁরা চিত্রশিল্পী নন বা ছবি আঁকেন না, তাঁদের যদি ছবি আঁকতে বলি, তাহলে কেমন হয়? সেই থেকে শুরু হলো আমার নতুন এক সাম্রাজ্য। একদিন শামসুর রাহমানের সামনে খুলে ধরলাম অটোগ্রাফ খাতা। ছবি আঁকতে বললে কবি জানালেন, এই বিষয়ে তাঁর অদক্ষতার কথা; কিন্তু শেষমেশ আবার আঁকলেনও। বাংলাদেশে তখন প্রায়ই দৈনিকের পাতায় নারী নির্যাতন ও অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়া ছবিসহ খবর ছাপা হয়। কবি আঁকলেন ‘ভীতসন্ত্রস্ত নারী’। বিভিন্ন রঙের কলমে আঁকা বাঙালি নারীর সংকট এবং সমাজে তার অবহেলার যে চিত্র, তা যেন ছবিতে চিরঞ্জীব হয়ে রইল।
এরপর আমার অনুরোধে তিনি এঁকেছেন আরও অজস্র ছবি।

কবি শামসুর রাহমানের প্রিয় ফতুয়া। ফতুয়ার গায়ে কবি লিখেছিলেন, ‘আমাকে মনে না রাখলে ক্ষতি নেই, আমার কবিতাকে ভুলে যেও না।’


যে চশমা দিয়ে তিনি চারপাশ—ঘরবাড়ি, প্রকৃতি ও প্রিয়জনদের দেখতেন, সেটিও একসময় দিয়েছিলেন আমাকে। এটি হরহামেশা যেন নড়েচড়ে ওঠে আমার সংগ্রহশালায়। তাঁর জুতা, জামা, বইপত্র, লেখার পাণ্ডুলিপি চিত্রকর্ম, চশমা ও ব্যবহূত বহু জিনিসের মেলায় কবির নিত্য বসবাস এখন আমার বসতবাটিতে। না, আমাদের কাছ থেকে তিনি বিদায় নিতে পারেননি—তাঁর বিপুল সৃষ্টিকর্মে বেঁচে থাকবেন শামসুর রাহমান। বাঙালি যেমন তাঁর কবিতাকে মনে রাখবে, তেমনি মনে রেখেছে তাঁকেও। তিনি আছেন, কে বলে তিনি নেই!