>মাঠের মাশরাফি িবন মুর্তজাকে তো সবাই চেনেন। কঠিন সব পরিস্থিতির বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করা এক ‘টাইগার’ তিনি। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের (ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টি) অধিনায়ক মাশরাফি খেলার বাইরে মানুষ হিসেবে কেমন? সেটাই বোঝার জন্য আমরা কথা বলেছি ‘নড়াইল এক্সপ্রেসের’ মা–বাবার সঙ্গে, কথা হয়েছে মাশরাফির সঙ্গেও। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে খেলার বাইরের অন্য এক মাশরাফির ছবি। এই নিয়ে এবারের মূল রচনা।

বন্ধুসভার সুমন ও কোমল বলল, ‘স্কুলের ঠিক পেছনেই মাশরাফির বাড়ি। যাবেন?’
যাব না মানে? নড়াইলে এসেছি আর ক্যাপ্টেনের বাড়ি দেখে যাব না, তা কী করে হয়? মাশরাফি বিন মুর্তজা এখন ঢাকায়। সামনে ভারতের সঙ্গে সিরিজ। নিজেকে তৈরি করার জন্য ক্যাম্পে তিনি। বাড়িতে আছেন মাশরাফির মা–বাবা। আমরা তো বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখছি, মাশরাফির কথাবার্তায় কীভাবে ফুটে ওঠে দেশপ্রেম, কীভাবে তিনি উজ্জীবিত করে তোলেন গোটা দলকে। মা–বাবাই তো বলতে পারবেন, কীভাবে এমন সোনার ছেলে হয়ে উঠলেন আমাদের ক্যাপ্টেন।
২২ মে দুপুরে নড়াইল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে প্রথম আলো আর এইচএসবিসি আয়োজিত ভাষা প্রতিযোগ শেষ হলো। ঠা ঠা রোদ্দুর উপেক্ষা করে আমরা কয়েকজন বেরিয়ে পড়লাম মাশরাফির বাড়ির উদ্দেশে। আমরা মানে বন্ধুসভার সুমন ও কোমল, প্রথম আলোর নড়াইল প্রতিনিধি কার্ত্তিক দাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফিন রুবাইয়াত, প্রথম আলোর আলতাফ শাহনেওয়াজ আর আমি।
সাইফিন রুবাইয়াত, যাঁর ডাকনাম শুচি, চুপিচুপি বললেন, ‘মাশরাফি আমার জীবনের প্রথম ক্রাশ!’
‘ক্রাশ’ শব্দটির জন্ম–ইতিহাস ও বিবর্তন নিয়ে ভাষাতাত্ত্বিক বিতর্ক উপেক্ষা করে আমরা এই শব্দটির সঙ্গে মাশরাফির একটি সম্পর্ক তৈরিতে সচেষ্ট হই। অচিরেই কয়েকটি ফোন আর ফেসবুকে কথাবার্তা চালিয়ে আমরা পরিষ্কার ধারণা পাই, নিজের অজান্তেই মাশরাফি অনেকগুলো তরুণ হৃদয়কে রাঙিয়ে দিয়েছেন রোমান্টিক আবহে। ‘ক্রাশ’–এর শিকার নারীর সংখ্যা একেবারেই কম নয়। কিন্তু তাদের খবর কে কবে রেখেছে? মাশরাফি কি জানেন, তিনি কত নারীর দীর্ঘশ্বাসের জন্মদাতা?
২.
পথেই পড়ে একটি মাঠ। বেশ বড়। আতাউর রহমান ক্রিকেট একাডেমির মাঠ সেটা। নানার নামে এই একাডেমি। মাশরাফিই এর পৃষ্ঠপোষক। শৈশবে একবার বাবার ইচ্ছে হয়েছিল ছেলেকে গান শেখাবেন। গানের শিক্ষক রাখা হলো। শিক্ষক দরদমাখা কণ্ঠে শুরু করলেন সরগম—সা রে গা মা পা ধা নি সা; মাশরাফি সেই সুরের মূর্ছনা অগ্রাহ্য করে তাকিয়ে থাকলেন এই মাঠের দিকে। বাবা বুঝলেন, এ ছেলেকে দিয়ে আর যা–ই হোক সংগীত হবে না। তাই সেখানেই ঘটল মাশরাফির সংগীতজীবনের ইতি।
এই কথাগুলো আমরা শুনলাম মাঠ পেরিয়ে মাশরাফির বাড়িতে ঢোকার সময়। দুজন মাটির মানুষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের যেন বরণ করে নিলেন। গোলাম মুর্তজা আর হামিদা মুর্তজা। যত্ন করে বসালেন বৈঠকখানায়। তাঁদের চোখ–মুখ থেকে বের হচ্ছিল পরিতৃপ্তির আলো। বিভিন্ন সময় মাশরাফির পাওয়া ট্রফিগুলো জানিয়ে দিচ্ছিল, আমরা এখন ক্যাপ্টেনের বাড়িতে।
৩.
সাদামাটা একতলা বাড়ি। শুরুতেই জানা হয়ে গেল, তাঁরা বিশ্বাস করেন, সুখের সঙ্গে আলিশান বাড়িঘরের কোনো সম্পর্ক নেই। এই যে বাড়িটি, তার প্রতিটি দরজা খোলা। যার যখন ইচ্ছে সে ঢুকছে, বের হচ্ছে। পরিবারের দুই ছেলে থাকে ঢাকায়, তাই বলে কি বাড়িতে শুধু মাশরাফির বাবা–মা থাকেন? মোটেই না। অন্তত ১০ জন এতিম বাচ্চা এই বাড়িটিকে আলো করে রেখেছে। এদের কাজ পড়ালেখা আর খাওয়া–দাওয়া করা। মাশরাফিকে হামিদা মুর্তজা বলেই রেখেছেন, আরও কিছুদিন গেলে তিনি গরিব শিশুদের জন্য নিজ খরচে একটি এতিমখানা করবেন। দিশাহীন শিশুরা পাবে আশ্রয়, এর চেয়ে সুখের ভাবনা আর কিছুই হতে পারে না বলে জানালেন ক্যাপ্টেনের মা।
অতীব সুখের সঙ্গে বাবা বললেন, ‘আমরা আমাদের বাড়ির কোনো আলমারিতে তালা দিই না।’
৪.
আপনারা কি সব সময় অনুভব করেছেন যে মাশরাফি একটু অন্য রকম ছেলে?
এবার মুখ খোলেন বাবা। ‘সে একজন কঠিন দেশপ্রেমিক মানুষ। সেটা আমি এতখানি জানতাম না। এবার বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের নেলসনের মাঠে সেটা কিছুটা টের পেয়েছি। অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে গিয়েও তা আরেকবার বুঝেছি। সে খুব ধর্মপরায়ণ, দেশপ্রেমিক, সৎ একটা ছেলে। অন্যের জন্য একটু উপকার করতে পারলে ওর মুখ খুশিতে ভরে ওঠে। দেশপ্রেমের কথা বলছেন, বাংলাদেশের চেয়ে প্রিয় জায়গা ওর আর নেই কোথাও।’
হামিদা মুর্তজা বলেন, ‘ওর তো কোনো দিনই কোনো চাহিদা ছিল না। শীতকালে যদি সোয়েটার না থাকত, ও পাঁচ–ছয়টা শার্ট একবারে পরে নিত। লুঙ্গি ছিঁড়ে গেলেও কাউকে কিছু বলত না। বরং মজা করে আমাকে বলত, আম্মা, বলো তো কয়টা শার্ট গায়ে দিয়েছি? আর জানেন, কোনো ম্যাচে জিতলে আমাকে ফোন করে বলবে, আম্মা তুমি খুশি? আর জিততে না পারলে ঘরে বসে থাকবে একা একা। কারও সঙ্গে কথা বলবে না। বউ–বাচ্চার সঙ্গেও কথা বলবে না। ও নিজের কষ্টটা কাউকে জানতে দিতে চায় না। ও কোনো দিন কারও কাছে কিছু চায়নি।’
এ সময় নড়াইলের বিখ্যাত দই আর মিষ্টি আসে। সঙ্গে আসে লিচু আর কলা। কথায় ছেদ পড়ে। অন্যদিকে ঘুরে যায় আলোচনা।
৫.
‘মাশরাফি, মানে আপনার কৌশিক কী খেতে ভালোবাসে?’
‘ওর প্রিয় খাবার আলুভর্তা, ডাল আর ভাত।’
‘গান শোনে?’
‘আগে তো শুনত জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হিন্দি গান। তো একদিন ওর আব্বা বলল, রবীন্দ্রসংগীতটা শুনে দেখ, কী আছে ওতে। এখন ও রবীন্দ্রসংগীতও শোনে।’
‘নাটক, সিনেমা?’
‘এখন বাংলাদেশের টেলিভিশনের নাটকের সিডিগুলো কিনে দেখে। আর সেদিন দেখলাম, একনাগাড়ে দেখছে উত্তম–সুচিত্রার সিনেমা।’
৬.
মাশরাফির জীবনে সবচেয়ে প্রভাব ফেলা মানুষটি তাঁর নানি খালেদা রহমান।
‘অনেকে বলে, মায়ের চেয়ে সন্তানকে বেশি ভালোবাসে যে, সে ডাইনি। ওটা আসলে ভুল ধারণা। কেউ যে মায়ের চেয়েও তার সন্তানকে বেশি ভালো বাসতে পারে, সেটা আমি কৌশিকের নানিকেই দেখেছি।’ বললেন হামিদা মুর্তজা।
৭.
আরও অনেক কথা হয়। তার প্রতিটি শব্দেই আমাদের সামনে উন্মোচিত হতে থাকেন এক মানবহৃদয়। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের (ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টি) অধিনায়ক মাশরাফি দল ও দেশের জন্য এক অসাধারণ প্রেরণাদাতা হয়ে উঠলেন কীভাবে, তা যেন আমরা একটু একটু করে বুঝতে থাকি। পরিবার, নড়াইলের আবহাওয়া, নড়াইলের মানুষই বোধ হয় মাশরাফিকে এ রকম করে তুলেছে। মাশরাফির মাঠে টি–টোয়েন্টি খেলা হচ্ছে, স্কোরবোর্ড সেখানে সচল, আর মাঠের দেয়ালজুড়ে জ্বলজ্বল করছে ‘মাশরাফি তুমি দীর্ঘজীবী হও’—এ যেন নড়াইলের ভবিষ্যৎ ক্রিকেটের অবকাঠামোর কথাই ইঙ্গিত করছে। স্নেহের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া ক্যাপ্টেনের মা–বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মনে হলো, এ যেন এক পবিত্র তীর্থস্থান দর্শন হলো।
৮.
২৭ মে যখন মাশরাফিকে ফোন করি, তখন তিনি মিরপুর স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলছেন। ক্রীড়া সাংবাদিক তারেক মাহমুদ সেখানে অপেক্ষা করেন আমার সঙ্গে ক্যাপ্টেনের কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য। হাঁপাতে হাঁপাতে কথা বলেন মাশরাফি।
‘আমরা নড়াইলে আপনাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আপনার প্রিয় খাবার কী, জিজ্ঞেস করেছিলাম মাকে। তিনি কী বললেন, বলতে পারবেন?’
‘আলুভর্তা, ডাল আর ভাত।’
‘আপনার পছন্দের মাছ–মাংস?’
‘কই মাছ আর গরুর মাংস।’
‘দেখলাম নড়াইলে আপনাদের মাঠে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছে।’
‘এলাকার লোকেরাই আয়োজন করেছে। আপনারা তো জানেন, ওদের আর্থিক অবস্থা ভালো না। আমরা যখন খেলতাম, তখন ভালো ছিল। কিন্তু সবাই তো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গেছে। তাই এখন ওদের জন্য খেলা কঠিন হয়ে গেছে। টানা কয়েক বছর ধরে নড়াইলে তো লিগও হয় না। আমার যারা স্পনসর তাদের মাঝে মাঝে বলি সাহায্য করতে। পাইলট ভাই একসময় ব্যাট–প্যাড দিয়ে সাহায্য করেছেন। মুশফিক করেছে। টুকটাক করে চালিয়ে দিচ্ছি একাডেমিটা।’
‘নড়াইলে যার সঙ্গেই কথা বলেছি, সে–ই আপনাকে নিয়ে মুগ্ধ। কেমন লাগে মানুষের এই ভালোবাসা?’
‘এটাই আমার জীবনের বড় পাওয়া। মানুষ আমাকে অনুভব করে, এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে?’
‘সবখানেই আপনার দেশপ্রেমের প্রসঙ্গটা আসে। এটা আপনি কীভাবে দেখেন?’
এবার মাশরাফি একটু সময় নেন উত্তর দিতে। তারপর বলেন, ‘জানি না এটা দেশপ্রেম কি না। আমি তো পৃথিবীর অন্তত ২০–২৫টা দেশ ঘুরেছি। কিন্তু কখনোই আমার মনে হয়নি, আমার দেশটা কোনো দেশের চেয়ে ছোট। আমাকে যদি কেউ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অন্য দেশে থাকতে বলে, তাহলেও আমি তা নেব না। ফিরে আসব দেশে। এটা দেশপ্রেম কি না জানি না। শোনেন, বিশ্বাস একটা বড় জিনিস। সহজভাবে কত কথাই তো আমরা বলে ফেলি। কিন্তু যে বিশ্বাস করে কিছু বলে, সে–ই বলে সত্য কথা। আমি আমার দেশকে খুব ভালোবাসি।’
‘আপনি কোনো দিন কারও কাছে কিছু চাননি...’
‘ঈদে কারও কাছে কিছু চাইনি। যা পেয়েছি, তাতেই মন ভরেছে। কিন্তু চেয়েছি একবার। আমার তো ক্রিকেট ব্যাট, প্যাড কিছুই নিজের ছিল না। জাতীয় দলে খেলি, কিন্তু আমার নিজের ব্যাট নেই। তাই আম্মুকে বললাম, আম্মু, আমারে একটা ক্রিকেট সেট কিনে দিবা? আমি বুঝতে পারছিলাম, এটা আমার আব্বার জন্য খুব কঠিন হবে। আমার খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু ধারদেনা করে আব্বা আমার হাতে ২০ হাজার টাকা তুলে দিয়েছিলেন। জীবনে ওই একবারই আমি কিছু চেয়েছিলাম।’
‘বাংলা দেশাত্মবোধক গান নাকি আপনার খুব পছন্দ?’
‘শোনেন, একুশে ফেব্রুয়ারি আর মুক্তিযুদ্ধের যে গানগুলো আমাদের আছে, তা হলো বিশ্বসেরা। এ রকম অনুপ্রেরণা দিতে পারে, এমন গান কি আর কারও আছে? আমার কী মনে হয় জানেন? ফিলিংস বা অনুভবটা হলো মূল। ওটা থাকলে দেশের কথাই সবার আগে মনে পড়বে।’
৯.
মাশরাফি বিন মুর্তজার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে, তাঁদের সাহচর্য পেয়ে এটাই মনে হলো, সময়ের যান্ত্রিকতার ছাপ এই পরিবারটির মধ্যে একেবারেই লাগেনি। বিনয়ের কাছে তাঁরা নতজানু। আর সেই বিনয় তাঁদের করে তুলেছে অন্য রকম। তাই জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড দাবদাহের মাঝেও আমরা পেয়ে যাই ভালোবাসার শীতল পরশ। মাশরাফির বলা ‘অনুভব’ শব্দটি যেন আমরা আরও নিবিড়ভাবে অনুভব করতে থাকি।