চালক থেকে সফল খামারি

লোহাগাড়ার প​ুঁটিবিলা ইউনিয়নের পহরচান্দায় নিজের খামারে আমের পরিচর্যা করছেন লিয়াকত আলী। বাগান থেকে পেড়ে আনা আম স্তূপ করে রাখা হয়েছে খামারের একটি শেডে (ইনসেটে)। খঁাচা ভর্তি করে এসব আম সরবরাহ করা হয় ​দেশের বিভিন্ন স্থানে l প্রথম আলো
লোহাগাড়ার প​ুঁটিবিলা ইউনিয়নের পহরচান্দায় নিজের খামারে আমের পরিচর্যা করছেন লিয়াকত আলী। বাগান থেকে পেড়ে আনা আম স্তূপ করে রাখা হয়েছে খামারের একটি শেডে (ইনসেটে)। খঁাচা ভর্তি করে এসব আম সরবরাহ করা হয় ​দেশের বিভিন্ন স্থানে  l প্রথম আলো

টানা ৩০ বছর বাস চালিয়ে সংসারের খরচ জুগিয়েছেন লিয়াকত আলী। আয়-রোজগার খারাপ ছিল না। তবে স্বপ্ন ছিল একটি বিষমুক্ত ফলের বাগান ও গবাদিপশুর খামার গড়ার। পাঁচ বছর আগে সেই স্বপ্নের পথে হাঁটা শুরু। এখন চালকের পেশা ছেড়ে তিনি পুরোপুরি সফল খামারি।
চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যানপাড়ার বাসিন্দা লিয়াকতের স্বপ্ন পূরণে বাধা ছিল কৃষি খামারের জন্য একটি বড় জায়গা ও মূলধন। অবশেষে এক নিকট আত্মীয়ের কাছ থেকে পুঁটিবিলা ইউনিয়নের পহরচান্দায় ১০ একর জায়গা পান। ওই আত্মীয়ের সঙ্গে যৌথ অংশীদারত্বে খামার গড়ার চুক্তি হয়। তাঁর কাছ থেকে মূলধনও পান। অবশেষে ২০১১ সালে পহরচান্দায় গড়ে তোলেন ফলদ বাগানসহ গবাদিপশুর খামার। নাম এম কে এম এগ্রো প্রোডাক্ট।
সম্প্রতি লিয়াকতের খামারে গিয়ে সারি সারি আমসহ নানা জাতের ফলের গাছ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। অনেক গাছেই এসেছে ফলন। লিয়াকত বলেন, একসময় বাড়িতে ফল কিনে আনলেও ছেলেমেয়েরা খুশি হতো না। ফরমালিন আছে সন্দেহে কেনা ফল খেতে চাইত না পরিবারের কেউ। তখনই মাথায় একটা ফলের বাগান করার ভাবনা আসে।
১০ একর জায়গার এক অংশে আছে গবাদিপশুর খামার ও সবজির খেত, অন্য অংশে ফলের বাগান। বাগানে নানা জাতের আম গাছই রয়েছে ১ হাজার ২০০। এর মধ্যে আম্রপালি, মল্লিকা, ল্যাংড়া, হাঁড়িভাঙা, হিমসাগর, স্বর্ণকমল ও লতা আম উল্লেখযোগ্য। রয়েছে বারোমাসি আমও। বেশির ভাগ আমের চারা তিনি নওগাঁ জেলার বিভিন্ন নার্সারি থেকে সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি রয়েছে লিচু, জাম, কমলা, কামরাঙা, পেয়ারা, বরই, পেঁপে ও কলা। প্রত্যেক গাছে গোবর ছাড়া অন্য কোনো সার ব্যবহার করা হয় না। খামারে যে ১৫টি গরু ও পাঁচটি গয়াল রয়েছে সেগুলোর গোবরই ব্যবহার করা হয় জৈব সার হিসেবে।
নিজ বাড়ি থেকে পহরচান্দায় অবস্থিত তাঁর খামারের দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। প্রতিদিন ভোরে তিনি খামারে যান এবং ফেরেন রাতে। বাগানে এত পরিশ্রমের পরও ক্লান্তি লাগে না বলে জানালেন তিনি। গাছে কোনো কীটনাশক ব্যবহার করেন না তিনি। খামারে পৌঁছে প্রথমে পুরো বাগানে একটা চক্কর দেন। খুঁজে দেখেন—কোনো গাছ দুর্বল হয়ে পড়েছে কিনা বা কোনো ফলে পোকার উপদ্রব হয়েছে কিনা। আক্রান্ত ফল ও গাছ তিনি ফেলে দেন বাগান থেকে। এরপর পোকা দমনে প্রচুর পানি ছিটান। মূলত পানি দিয়েই পোকা দমন করেন তিনি। তবে এরপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নেন।
লিয়াকত আলী বলেন, ‘বাগান তৈরির ওপর আমার কোনো প্রশিক্ষণ নেই। নিজে নিজেই চিন্তাভাবনা করে সব করেছি। একবার মিষ্টি কুমড়া চারা লাগিয়ে সেখানে পচা গোবর ব্যবহার করেছি। দেখেছি প্রত্যেকটা মিষ্টিকুমড়া ১৪-১৫ কেজি হয়েছে।’
বাগানে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে সৌর প্যানেলের মতো প্রযুক্তি। সৌর প্যানেলের মাধ্যমে বাগানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে সেচের জন্য মোটর চালাতে সমস্যা হয় না তাঁর।
খামার ও বাগান থেকে ফল, গবাদিপশু, সবজি পুরোপুরো বিক্রি শুরু হয়নি এখনো। এ বছর থেকে ফল ও পশু বিক্রি করছেন তিনি। ভালো লাভও পাচ্ছেন। এ বছর এর মধ্যেই এক লাখ টাকার আম বিক্রি হয়েছে। আরও আম বিক্রির অপেক্ষায় আছে। সামনের বছরগুলোতে কেবল চার-পাঁচ লাখ টাকার আম বিক্রি হবে।
ভালো আয় হচ্ছে সবজিখেত এবং গবাদিপশুর খামার থেকেও। এ বছর দুটি গয়াল তিন লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। বিক্রির অপেক্ষায় আছে আখ। এ ছাড়া কোরবানির ঈদ উপলক্ষে আরও কিছু পশু বিক্রি হবে। খরচ বাদ দিয়ে তাঁর মািসক আয় এখন ৪০ হাজার টাকার মতো। এ আয় ভবিষ্যতে কয়েক গুণ বাড়বে বলে তাঁর বিশ্বাস।
লোহাগাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লিয়াকত আলীর খামারটি একটি আদর্শ খামার। কোনো ধরনের রাসায়নিক মিশ্রণ ছাড়ায় তিনি বাগানে ফল ও সবজি উৎপাদন করেন।