ছোট্ট লাল পাখি

সামার ট্যানাজার
সামার ট্যানাজার

আমাদের বাড়ির তৃতীয় লেভেলের সোলারিয়ামের ব্যালকনিতে বসে একদিন স্কুলের হোমওয়ার্ক করছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা সুন্দর পাখি আমাদের বাড়ির সামনের ম্যাপল-গাছের ডালে উড়ে এসে বসল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ও পাখি, তোমার নাম কী?’
পাখিটা বলল, ‘আমার বৈজ্ঞানিক নাম পাইরাংগা রুবরা। লোকে আমাকে সামার ট্যানাজার বলেও চেনে। কেউ কেউ আবার আমার গায়ের রঙের জন্য লাল পাখি বলেও জানে। আমরাই হচ্ছি উত্তর আমেরিকার উজ্জ্বল রঙের একমাত্র লাল পাখি। তো তুমি আমাকে ছোট্ট লাল পাখি বলে ডাকতে পারো।’
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, ছোট্ট লাল পাখি বলেই ডাকব। কিন্তু ছোট্ট লাল পাখি, তুমি কি ​জানো, আমার নামের সঙ্গে তোমার বৈজ্ঞানিক নামের কিছুটা মিল আছে? তোমার নামের শেষ অংশ “রুবরা” আর আমার নামের প্রথম অংশ “রুবামা”। আমার পুরা নাম রুবামা রহমান।’
ও বলল, ‘হ্যাঁ তাই তো। নামে যখন মিল আছে এসো তাহলে আমরা বন্ধু হই।’
‘ঠিক আছে, বন্ধু না হয় হলাম। তো ছোট্ট লাল পাখি, তোমার দেশ কোথায়, কোথায় তোমার বাড়িঘর?’
‘বাড়িঘরের কথা বলতে গেলে সে হবে এক লম্বা কাহিনি। তবুও সংক্ষেপে বলি, আমাদের বাড়ি হচ্ছে আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্বে। আমার দাদাবাড়ি ছিল জর্জিয়ায় আর নানা বাড়ি হলো আলাবামায়। তারপর মা-বাবার মিলনের পর এখন আমরা দক্ষিণ ক্যারোলিনায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছি। আমি মা-বাবার সঙ্গেই থাকি। সুখী একটা পরিবার আমাদের।’
‘তা তুমি কানাডার অন্টারিওতে কী করে এলে?’
‘আমার মা আমাকে বকা দিয়েছে। সে একটুতেই আমার ওপর মীন হয় আজকাল। আর চটে যায় আমার হাবভাবে। জানো, কেউ আমাকে বকলে মনটা আমার খুব খারাপ হয়ে যায়। তাই রাগ করে ঘুরতে ঘুরতে উড়ে চলে এসেছি এদিকটায়। এই সুদূর উত্তরে তোমাদের কানাডায়। তবে থাকব না বেশি দিন। ফিরে যাব। তোমাদের এখানে অনেক ঠান্ডা। শীত আর ঠান্ডা আমাদের একদমই ভালো লাগে না। শীতকাল এলে আমরা দল বেঁধে উড়াল দিই আরও দক্ষিণে। হয় বাহামায়, নয়তো মেক্সিকোর দিকে। ওখানে খুব মজা হয়। সমুদ্রসৈকতের অদূরে সারি সারি গাছগাছালিতে শুয়ে-বসে রোদ পোহানো যায়।’
‘বেশ ভালো। আচ্ছা ছোট্ট লাল পাখি, তোমরা কী খাও?’
‘আমরা পোকামাকড়, ফলমূল যখন যা জোটে তা-ই খাই। তবে উড়ন্ত পোকা শিকার করতে আমরা খুবই পটু। বিশেষ করে মৌমাছি ও বোলতা ধরতে। তবে আমরা খাওয়ার আগে গাছের ডালে আছাড় দিয়ে ওদের হুলগুলো ভেঙে ফেলি। এ ছাড়া আমরা পিঁপড়া, মাকড়সা, উইপোকা ও ফড়িংও পছন্দ করি। ফলের মধ্যে ব্লাকবেরি, মালবেরি, লেবুজাতীয় ফল ও পাকা কলা খাই।’
‘তোমার গায়ের রং এত টুকটুকে লাল কেন? একেবারে আলতা-সিঁদুরে রাঙানো। তোমার সঙ্গীদের কথা কিছু বলো?’
‘ও, তুমি হয়তো বুঝতে পারনি যে আমি একটা বয় পাখি। আমরা বয়রা বয়ঃসন্ধিকালে এমনই রঙে রঙিন হয়ে উঠি। তবে ছোট্টবেলায় আমার গায়ের রং ছিল বেমানান লাল এবং হলদে-সবুজে মেশানো। মনে হতো কারা যেন ছোপ ছোপ রং গায়ে ঢেলে দিয়েছে। এখন আমি বয়ঃপ্রাপ্ত, তাই এমন সুন্দর লাল পোশাক নিয়েছি। আমাদের গার্লদের রং অবশ্য ভিন্ন। তাদের গায়ের রং হয় সরষে-হলুদ। গার্লদের দেখলে মনে হয় যেন ইরানি গোলাপ। জানো, ওরা কিন্তু খুব লাজুক। বেশি একটা বাইরে ঘোরাফেরা করে না। ঘরেই থাকে আর মায়েদের কাজে সাহায্য করে। তবে অলস মুহূর্তে ওরা উসখুস করে আর আমাদের সঙ্গে মিশতে চায়। ওরা যখন ঘুরঘুর ও উঁকিঝুঁকি মেরে চাকলিং করে, তখন আমরা বুঝতে পারি। আমরা বয় ও গার্লরা ভিন্ন রঙের দেখতে হলে কী হবে, আমাদের ভালো লাগা ও ভালোবাসার সুর কিন্তু একই রকমের। আর সেই মিষ্টি সুরটা হলো, পিক-ই-টুক-ই-টুক, পিক-ই-টুক-ই-টুক।’
‘ওমা, এ যে দেখছি রবিনের সুর ও গান।’

সামার ট্যানাজার

‘ওই যে, সব্বাই এই ভুলটা করে। আমদের গান শুনে মনে করে রবিন পাখি গান করছে। আসলে তা নয়। এটা আমদের অরিজিনাল সুর ও সংস। একেবারেই আমাদের নিজস্ব শিস দেওয়া গান।’
‘ও তাই। ছোট্ট লাল পাখি, তোমার এই জীবনকে কেমন লাগে? আমি তো ভীষণ বোর হয়ে যাই। আমার আর স্কুলে যেতে ভালো লাগে না।’
‘জীবনকে আমার খুবই ভালো ও উপভোগ্য মনে হয়। মুক্ত বাতাসে এই উড়ে বেড়ানো কী যে আনন্দের ব্যাপার, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। এ যেন এক অপার স্বাধীনতা। কোনো চিন্তাভাবনা নেই, স্কুলে যেতে হয় না। প্রচণ্ড আনন্দ আর সুখের উল্লাসে শুধুই ঘুরে বেড়ানো।’
‘তুমি তো জীবনকে তাহলে খুব এনজয় করো। তাই না?’
‘দেখো না, সারা বিশ্বে কত হানাহানি হচ্ছে আজকাল। কিছু হলেই আমাদের মতো বাচ্চা শিশুরা হত্যাযজ্ঞের শিকার হচ্ছে। এই বর্তমান বিশ্ব ও পরিবেশ সম্পর্কে কী ধারণা তোমার?’
‘তুমি ঠিক বলেছ। পৃথিবীতে হানাহানি ও সংঘাতের ঘটনা বেড়েই চলেছে। এতে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও কিশোরেরা, যারা নাকি আগামী দিনে এই পৃথিবীর হাল ধরবে। সংঘাত আর সংকটে অসহায় শঅ-বাবার সঙ্গে শিশুরা আজ উদ্বাস্তু হচ্ছে। কেউ যেন কোনো নিয়মনীতি মানছে না। বনাঞ্চল উজাড় করছে, অতিরিক্ত ফসিল ফুয়েল ব্যবহার করে বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ছড়াচ্ছে, প্লাস্টিক ও কেমিক্যালস এখন তোমাদের নিত্যসঙ্গী হয়েছে। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে। জলবায়ু ও আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে, যা আমাদের ইকো-সিস্টেমের সব প্রাণিকুলের জন্য হুমকিস্বরূপ। সবাই মিলে এখনই এর ব্যবস্থা না নিলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। এই গ্রহ থেকে হয়তো আমরা একদিন হারিয়েই যাব।’
‘হুম, কথাটি ঠিক বলেছো।’
‘আমাদের আসলে সব্বায়কে বুঝতে হবে যে, এই অবস্থার জন্য আমরা সবাই কম-বেশি দায়ী। পরিবেশকে ভালোবাসতে নিজ নিজ ভূমিকা সঠিকভাবে পালন না করলে এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনোই পথ নেই।’
‘ঠিক আছে ছোট্ট লাল পাখি, তোমার সঙ্গে কথা বলে খু-উ-ব ভালো লাগল। তো, তুমি আর রাগ করে থেকো না। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। তোমার মা-বাবা কতই না দুশ্চিন্তা করছেন। আর আমারও স্কুলের হোমওয়ার্কও শেষ করতে হবে। বাই ফর নাউ, বিদায় বন্ধু। নিজের খেয়াল রেখো।’
ছোট্ট লাল পাখি বিদায় নিয়ে ম্যাপলের ডাল থেকে উড়ে গিয়ে পাখা মেলল দখিনা হাওয়ায়।

রানা টাইগেরিনা
টরন্টো, কানাডা