পরিবারের মুক্তিযোদ্ধাকে চিনুন

আপনার নিজ পরিবারে কিংবা দূরবর্তী স্বজনদের মধ্যেই হয়তো আছেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তা আপনি জানেনও নিশ্চয়ই। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে কখনো হয়তো যুদ্ধের গল্প শোনা হয়নি, শোনানো হয়নি নতুন প্রজন্মকেও। তাঁকে নিয়ে একটু বসা যায়। বাড়ির সবাইকে নিয়ে বলা যায়, আজ আমরা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনব

মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম তরুণ প্রজন্মকে জানাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প। মডেল: ফাহিম, নাসা, নওরীন, ফয়সাল, নাবিল ও জীবন। ছবি: সুমন ইউসুফ
মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম তরুণ প্রজন্মকে জানাচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের গল্প। মডেল: ফাহিম, নাসা, নওরীন, ফয়সাল, নাবিল ও জীবন। ছবি: সুমন ইউসুফ

ডিসেম্বর মাস। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। ঢাকা শহরের একটি বাড়ির ছাদে গোল হয়ে বসেছে সবাই। খিচুড়ি আর গরুর মাংস রান্না হয়েছে আজ। দোতলার রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে তার সুবাস। আজ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা হবে। একটু আগে ছাদে ছুটে বেড়াচ্ছিল পরিবারের শিশুরা। এখন তারাও বড়দের সঙ্গে গোল হয়ে বসেছে। এরই মধ্যে একজন মৃদুমন্দস্বরে আবৃত্তি করল আসাদ চৌধুরীর কবিতা, ‘তোমাদের যা বলার ছিল, বলছে কি তা, বাংলাদেশ’?

ছয় বছরের শিশুটি উসখুস করছিল। মায়ের আঁচলে মুখ ঢেকে নিয়ে ফিসফিস করে ও জিজ্ঞেস করল, ‘কাদের কথা বলছে মা?’ ‘তোমার দাদার কথা। মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের কথা।’ শিশুটি আর কথা বলে না। আজই ও পত্রিকায় দেখেছে রায়েরবাজার বধ্যভূমির ছবি। সেখানে লাশের পর লাশ।
অন্য একটি ছবিতে ও দেখেছে, দেশ স্বাধীন করে ঘরে ফিরছে মুক্তিযোদ্ধার দল। ওদের হাতে অস্ত্র, কণ্ঠে স্লোগান! দুটি দুধরনের ছবি। একটি দেখলে কান্না আসে, অন্যটিতে আনন্দে ভরে যায় মন। ছবি দুটি দেখে মুক্তিযুদ্ধের একটা মানে দাঁড় করিয়ে নিয়েছে শিশুটি। আবৃত্তির পর সবাই চাদরে মাথা ঢাকা মানুষটার দিকে তাকায়। শিশুরাও।
লোকটি প্রতিবছরই গ্রাম থেকে একবার এই ডিসেম্বর মাসে ঢাকায় আসেন। ওঠেন এই বাড়িতেই। বাড়ির কর্তা তাঁর চাচাতো ভাই। সবাই জানে, তিনি একাত্তরের ডাকসাইটে মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু হঠাৎ এ বছরই সবাই আবিষ্কার করে, তাঁর কাছ থেকে কোনো দিন মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা হয়নি। তাই, এবার সবাই মিলে বেছে নিয়েছে পূর্ণিমার রাতটিকে, মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার জন্য।

‘একবার আমরা ধানখেত দিয়ে ক্রলিং করে যাচ্ছিলাম। অন্যদিক থেকে একইভাবে আসছিল পাকিস্তানি বাহিনী। হঠাৎ ওদের দিক থেকে একজন সাদা কাপড় উড়িয়ে আমাদের দিকে আসতে থাকল। এ অবস্থায় গুলি করা যায় না। লোকটি এসে বলল, “আমরা বেলুচ রেজিমেন্ট। তোমাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তোমরা একদিক দিয়ে চলে যাও, আমরা অন্যদিক দিয়ে যাই।” বেলুচরা চলে গেল। এমন ঘটনাও ঘটেছে আমার জীবনে।

‘আবার অন্য একবার একটা গ্রামে গিয়ে দেখলাম, একটি বাড়িতে এক মা আর তাঁর তিন-চার বছরের মেয়েকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে চলে গেছে পাকিস্তানিরা। আমাদের মনে তখন প্রতিশোধের আগুন! ওই গ্রামের রাজাকারদের ধরে আমরা শাস্তি দিয়েছি।’
‘কী শাস্তি?’ সেই ছোট্ট ছেলেটির চোখে পানি, ঠোঁটে প্রশ্ন।
‘একটি তিন-চার বছরের শিশুকে যারা হত্যা করে, তারা যে শাস্তি পেতে পারে, সেই শাস্তি।’
এভাবে তিনি বলে যেতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। সবাই নির্বাক হয়ে শুনতে থাকে। নদীতে ভেসে যাওয়া লাশ, ডোমের কান্না, চোখের সামনে সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধার ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া মৃতদেহ, যুদ্ধের মাঠে মৃত্যুর উৎসবের মধ্যে হঠাৎ করে খবর পান দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন...
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, শ্রোতাদের মনের ক্যানভাসে শুধুই একাত্তর...।

বাড়িতে শুনি মুক্তিযুদ্ধের গল্প

ওপরের গল্পটি সত্য। বছর দুই আগের ঘটনা এটি। একটি বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার জন্য এমনই এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিনের পর থেকে ওই বাড়িটিতে মুক্তিযুদ্ধের অর্থই পাল্টে গিয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান হয়ে উঠেছিল প্রগাঢ় তাৎপর্যময়, যুদ্ধের সিনেমাগুলো হয়ে উঠেছিল একান্ত নিজের বাড়ির গল্প যেন...আর মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, গল্প আর কবিতার বইগুলোতে ভরে গিয়েছিল বইয়ের আলমারি...
আপনার নিজ পরিবারে কিংবা দূরবর্তী স্বজনদের মধ্যে কি একজন মুক্তিযোদ্ধাও নেই? নিশ্চয়ই আছে। আপন এই মানুষটির কাছ থেকে কখনো হয়তো যুদ্ধের গল্প শোনেননি। তাঁকে নিয়ে একটু বসুন। বাড়ির সবাইকে বলুন, আজ আমরা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনব। যারা একাত্তর দেখেনি, তাদের আগে থেকেই প্রস্তুত করে রাখুন যুদ্ধের সেই আনন্দ-বেদনার কাব্য শোনার জন্য।
ছবিতে যাকে দেখছেন, যিনি নতুন প্রজন্মের তরুণদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছেন, তাঁর নাম আমিনুল ইসলাম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। যুদ্ধ করেছেন রাজবাড়ী এলাকায়। আপনার আশপাশ দিয়েই তাঁর মতো এমন কেউ হয়তো হেঁটে চলে যান, আপনি জানতেও পারেন না, তিনি নিজের সঙ্গে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন গোটা একাত্তর...একটু কথা বললেই যাঁর স্মৃতির পাখিরা বেরিয়ে এসে উড়তে থাকবে আপনার চারপাশে এবং সেই পাখিরা এসে ঘর বাঁধবে আপনারই মনের বাড়িতে।
তাঁরা যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, দেখবেন, তাঁদের চোখে ভর করেছে একাত্তর। বর্ষীয়ান এই মানুষেরা তখন যেন অন্য গ্রহের মানুষ। স্মৃতির ভেলায় ভেসে তাঁরা পিছিয়ে যান তাঁদের জীবনের সেরা সময়টিতে। তরুণ মুক্তিযোদ্ধাই যেন তাঁরা, যাঁদের বয়স বাড়ে না আর।

আমাদের সৌভাগ্য, এখনো দেশে এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন, যুদ্ধের স্মৃতিতে যাঁদের মরিচা পড়েনি। তাঁরা যদি তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, তাহলে আপনার সন্তান অথবা নাতিও কিন্তু ঘুরে আসতে পারবে সেই সময়টি থেকে, যে সময়টি আমাদের সবচেয়ে গর্বের। যে ইতিহাস আমাদের দিয়েছে জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা আর একটি স্বাধীন দেশ।