পৌরাণিক বিশ্বাস যাদের খুনি বানিয়েছিল
আঠারো-উনিশ শতকে ভারতের বিভিন্ন জায়গার সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, তীর্থযাত্রীদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম ছিল ঠগি। তাদের হাতে পড়লে মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু কোথাও কোনো নিশানা খুঁজে পাওয়া যায় না এই মৃত্যুদূতদের। অনেক খোঁজা হয়েছে তাদের। ধরা না পড়ার ফলে নীরবে–নিভৃতে চলতে থাকে তাদের অভিযান। মানুষ হারিয়ে যায়, অপেক্ষায় থেকে থেকে স্বজনেরা একসময় আশা ছেড়ে দেয় তাদের বুকে পাথর বেঁধে। কোথাও কোনো চিহ্ন নেই! কিন্তু একসময় হঠাৎ করে হারিয়ে যেতে শুরু করল ঠগিরাই! ভয় ঢুকে গেল তাদের দলনেতার মনে। কীভাবে?
২.
ঠগি আছে ভারতজুড়ে। শহরের অলিগলি, বিজন মরুভূমি, নদী, পাহাড়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ধর্ষ খুনির দল। কিন্তু একজন ছাড়া কেউ বিশ্বাস করে না এ কথা। তিনি উইলিয়াম হেনরি স্লিম্যান।
লোকে হেনরি স্লিম্যানকে নিয়ে হাসাহাসি করে। কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করতে চায় না। ঠগি হয়তো কোনো এককালে ভারতবর্ষে ছিল, কিন্তু গত ১০০ বছরে ঠগির কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। তবে স্লিম্যানের নিশ্চিত বিশ্বাস, ঠগি আছে। কিন্তু কেউ জানে না ওদের খবর। আশ্চর্য, বড়ই আশ্চর্য!
১৮০৯ সালে তরুণ হেনরি স্লিম্যান ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে যোগ দেন সৈনিক হিসেবে। অভাবিত উন্নতি করেন। একজন বড় সৈনিক হওয়ার সব যোগ্যতা তাঁর ছিল। হঠাৎ কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ লাইব্রেরিতে পাওয়া একটি পুরোনো বই এলোমেলো করে দিল স্লিম্যানের জীবন।
বইটির লেখক এম থিভেনট নামের এক ফরাসি পর্যটক। বইয়ের ছত্রে ছত্রে ভরে আছে ঠগি নামের ভয়ংকর খুনিদের অজানা গল্প। একেবারে সত্যি গল্প। কিন্তু গল্প ওখানেই শেষ। বইটা প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো। ‘এখনো কি আছে ঠগিরা? না–ই যদি থাকবে, তাদের দমন করল কে?’ নিজেকেই প্রশ্ন করলেন স্লিম্যান। পরিচিত–অপরিচিত যাকেই পান, ঠগিদের কথা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু কেউ বলতে পারে না ওদের খবর। অগত্যা নিজেই খুঁজে বেড়ান পথে পথে, তীর্থযাত্রীদের সমাবেশে, মন্দিরে, মোড়লের কাছারিতে, মাঠে, ঘাটে, মেলায়, মানুষের জটলায়। লাইব্রেরি আর অফিসের পুরোনো কাগজপত্রের বান্ডিলে খুঁজে ফেরেন ঠগিদের নতুন কোনো গল্প।
অবশেষে উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদের কালেক্টর অফিসে পাওয়া যায় ডা. রিচার্ড শেরউডের ঠগিদের নিয়ে লেখা একটি পাণ্ডুলিপি। এটা বইটির মতো পুরোনো নয়। ১৭৯৯ সালের গল্প। ‘ঠগি’রা নেশার মতো পেয়ে বসল স্লিম্যানকে। এ জন্যই একসময় সৈনিকের চাকরি ছেড়ে যোগ দেন সিভিল সার্ভিসে—শুধুই ঠগিদের খুঁজতে। ১৮২২ সালে তিনি চলে যান মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে, গভর্নর জেনারেলের এজেন্ট হয়ে।
তত দিনে স্লিম্যান অবশ্য অনেক দূর এগিয়েছেন। ঠগিদের চালচলন, আচরণ অনেকটাই জেনে গেছেন ওই বই আর পাণ্ডুলিপি থেকে। জেনে গেছেন তাদের নিজস্ব ভাষাও। নিকট অতীতের অনেক ঘটনাই স্লিম্যান মন দিয়ে শুনেছেন স্থানীয় লোকদের কাছে। খতিয়ে দেখেছেন কোনো ঘটনার সঙ্গে মেলানো যায় কি না ঠগিদের যোগসূত্র।
একদিন অফিসে বসে তন্ময় হয়ে ভাবছেন ঠগিদের কথা। বাইরে একদল তীর্থযাত্রী ছিল। তাদের দেখে ভাবেন, এরা ঠগি নয়তো? তারপর আবার ভাবনায় ডুবে যান। হঠাৎ কে যেন এসে ডাকে। স্লিম্যান চোখ তুলে দেখেন কল্যাণ সিং দাঁড়িয়ে। তাকে তিন মাস আগে জেলে পাঠিয়েছিলেন স্লিম্যান। লোকটা কোম্পানির এক আস্তাবলে কাজ করত। ঘোড়ার খাবার চুরির অপরাধে জেল হয় তার। বড্ড গরিব। তাই তার পরিবারকে দেখেশুনে রেখেছিলেন স্লিম্যান। এ জন্য লোকটা তাঁকে ধন্যবাদ দিতে এসেছে। লোকটাকে স্লিম্যান কিছুক্ষণ আগে দেখেছেন ওই তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে।
‘তুমি বদ লোকের সঙ্গ নিয়েছ কল্যাণ সিং।’ আন্দাজে ঢিল ছুড়লেন স্লিম্যান। এরপর ঠগিদের কিছু মুখস্থ স্বভাবের কথা তুলে বললেন, ‘ওই দলের সরদার কথায় কথায় খুন করে, গামছা পেঁচিয়ে এভাবে...’ ভয় পেয়ে গেল কল্যাণ সিং। ভাবল দেবতা ছাড়া কারও পক্ষে এসব কথা জানার কথা নয়। সব স্বীকার করে ফেলল। একে বলে গেল অনেক রোমহর্ষক কাহিনি। স্লিম্যানকে আর পায় কে!
ঠগিরা ঘুরে বেড়ায় ছদ্মবেশে। দল বেঁধে। একেক দলে ঠগি থাকে কয়েক শ পর্যন্ত। পথে বেরিয়ে ওরা ভাগ হয়ে যায় ছোট ছোট দলে। একেক দল একেক বেশ নেয়। কোনো দল তীর্থযাত্রী, কোনো দলকে দেখে মনে হয় সাধারণ ব্যবসায়ী। হাটে, ঘাটে, মেলায় কিংবা তীর্থস্থানে ওরা লোকজনকে পরখ করে। খোঁজখবর নেয়। যদি বোঝে কারও কাছে টাকা কিংবা মূল্যবান জিনিস আছে, নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে। এরপর দুর্গম কোনো পথে ঠগির দলটা দেখা দেয় বন্ধুবেশে।
রাস্তায় কত বিপদ-আপদ। দলে ভারী হলে বড্ড সুবিধা। হতভাগা পথচারীরা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না বন্ধুবেশে তাদের পিছু নিয়েছে ভয়ংকর খুনির দল। ধীরে ধীরে দুই দলের মধ্যে সৌহার্দ্য হয়। একসঙ্গে খাবার ভাগ করে খায়। গানবাজনা চলে। তারপর হঠাৎ আক্রমণ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হতভাগ্যদের গলায় পেঁচিয়ে যায় গামছার মরণফাঁস। এরপর গোটা দলই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কেউ তাদের খোঁজ পায় না। আত্মীয়স্বজনেরাও পথ চেয়ে চেয়ে শেষমেশ তাদের আশা ছেড়ে দেয়। কিন্তু লোকগুলো কোথায় হারাল কেউ জানে না।
ঠগিদের একটা দল যায় ছল করে পথিকের মন ভোলাতে। আরেকটা দল তখন চলে যায় ঠিকঠাক জায়গা খুঁজতে—কবরের জায়গা। এরপর সেখানে কবর খোঁড়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে। দুই দলের মধ্যে সংযোগ রাখার জন্য আছে কয়েকজন গুপ্তচর। একদল চলে যায় আশপাশের ইংরেজ কাছারিতে। ভালো মানুষ সেজে খবর নিয়ে আসে পুলিশ বা সৈনিকদের। ব্যাপার খারাপ বুঝলে মূল দলের কাছে খবর পাঠিয়ে দেয়। ওই এলাকা থেকে তখন সটকে পড়ে ঠগিরা।
অস্ত্র বলতে মাত্র একটুকরো গামছা। গামছার এক কোণে এক টুকরো পাথর কিংবা দুটি তামার পয়সা বাঁধা থাকে। এরপর সুযোগ বুঝে হতভাগা পথচারীদের গলা লক্ষ্য করে ছুড়ে মারে সেটা। গলায় পেঁচিয়ে যায় গামছা। তখন হ্যাঁচকা একটা টানে পথচারীকে শুইয়ে ফেলা হয়। চার–পাঁচজন তার পিঠে চেপে বসে মৃত্যু নিশ্চিত করে। কখনো কখনো গামছার বদলে দড়িও ব্যবহার করে ঠগিরা।
এরপর দরকার হয় কোদাল। কোদালের হাতল থাকে না। যখন যেখানে দরকার জঙ্গল থেকে কাঠ বা বাঁশ দিয়ে হাতল তৈরি করে নেয়। কোদাল দিয়ে কবর খোঁড়ে আরেকটা দল। মূল দলটা যখন পথচারীদের ছল করে ভুলিয়ে রাখছে, অন্যদিকে তখন এই দলটা খুঁড়ছে কবর। বেশ দূরে, যেন আক্রান্ত লোকগুলো টের না পায়। কবর খোঁড়া শেষ হলে একজন এসে মূল দলে খবর দিয়ে যায়। এরপরই পথিককে খুন করে ঠগিরা। সব কটি লাশ এক কবরে ফেলে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এরপর কবরের ওপর তাঁবু গাড়ে ওরা। খাওয়াদাওয়া করে। এমনকি রাত যাপনও করে সেই তাঁবুতে। কারও বোঝার সাধ্য নেই কিছুক্ষণ আগে কী ভয়ানক কাণ্ড ঘটে গেছে।
পথচারীদের খুন করে তার সব সম্পদ লুটে নেয় ঠগিরা। সব সময় যে বড় অঙ্কের টাকা পায় তা নয়। দেখা যায়, মাত্র কয়েক পয়সা পাওয়া গেছে। তবুও খুনে ঠগিদের কোনো আফসোস নেই। ঠগিরা অন্য লোকদের ঠকায় কিন্তু দলের লোকদের কখনো চার আনাও ফাঁকি দেয় না। যে টাকা পায়, গোটা দলের মধ্যে সমান ভাগ হয়। যে বাজারের পুলিশের খোঁজ করতে গেছে, সে যতটুকু ভাগ পায়, স্পটে বসে যে খুন করছে, তার ভাগও ততটুকু।
৩.
ঠগিদের নানা শ্রেণি ছিল। এদের বড় অংশ খাঁটি ঠগি। আর বাকিদের বিভিন্ন নামে ডাকা হতো। আমাদের পূর্ব বঙ্গ চিরকালই নদী–নালার দেশ। এ দেশে স্থলপথে চলার চেয়ে জলপথে চলার সুবিধাই বেশি। তাই এখানকার ঠগিদের ধরনও আলাদা। এদের একটি দল নৌকার মাঝিগিরি করে। আরেকটা দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে হাটে-বাজারে। পথচারীদের সঙ্গে যোগ দেয়। বলে, ‘একা যেতে ভয় পাই বাবু, আমাকে যদি সঙ্গে নেন তো ভরসা পাই।’ পথচারী দেখে, ভালোই তো হলো এমন নির্জন পথে একা চলার চেয়ে সঙ্গী থাকলে মন্দ হয় না। দুজনে একসঙ্গে চলে। এরপর আরও সঙ্গী জোটে মাঝপথে। এদের কেউ ঠগি কেউ আসল পথচারী।
ঠগিরা পাকা অভিনেতা। এমন ভাব করে কেউই কাউকে চেনে না। এরপর সবাই মিলে নৌকায় ওঠে। অনেকগুলো নৌকা বাঁধা আছে ঘাটে। সব কটির মাঝিই ঠগি। প্রতিটি নৌকায় এমনভাবে যাত্রী তোলা হয়, যেন সাধারণ যাত্রীর চেয়ে ঠগিদের সংখ্যা বেশি হয়। এরপর গভীর নদীতে গিয়ে সুযোগ বুঝে ইশারা করে ঠগি সরদার। কিছু বুঝে ওঠা আগেই গলায় ফাঁস এঁটে যায় সওয়ারির। দ্রুত কাজ সেরে লাশ ভাসিয়ে দেয় নদীর পানিতে। জলের এই ঠগিদের নাম পাঙ্গু। সুবন জমাদার নামে এক কুখ্যাত পাঙ্গু ঠগি ধরা পড়ে স্লিম্যানের লোকদের হাতে। সুবন ময়মনসিংহ থেকে রংপুর, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর, মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তুলেছিল তার পাঙ্গু বাহিনী।
ধুতুরিয়া নামে আরেকটি দল ছিল। ওরা কম্বলের জন্য পথচারীদের খুন করত! ধুতরার বীজ দিয়ে বিষ তৈরি করত ওরা। এরপর পথচারীদের সঙ্গে ভাব করে কৌশলে হুঁকোর তামাকে বিষ ঢুকিয়ে দিত। ছটফট করে মারা পড়ত অসহায় পথিকের দল।
এ ছাড়া ভাগিনা, মাকফাঁসনা, তুমসবাজ নামে ছিল ঠগিদের আরও কয়েকটি সম্প্রদায়। সব দলই ঠকিয়ে মানুষ খুন করত। তাই এরা সবাই ঠগি। কিন্তু খাঁটি ঠগিদের মতো অত নিপুণ নয় এদের কাজ।
আর ছিল ঠ্যাঙাড়ে। বাংলায় এদের বেশি উৎপাত ছিল। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসে ঠগি ও ঠ্যাঙাড়েদের কথা জানা যায়। ঠ্যাঙাড়ের নির্মম এক গল্প আছে ওই বইয়ে। ঠগিদের কারণে গোটা ভারতবর্ষের পথে-প্রান্তরে হারিয়ে যেত প্রতিবছর বিশ হাজার মানুষ!
ঠগিরা বংশপরম্পরায় এই পেশা বেছে নিত। ঠগির ছেলে তাই ঠগিই হতো। ওদের বিয়ে, আত্মীয়তা—সব ঠগিদের মধ্যেই। বেশির ভাগ ঠগির স্ত্রী–সন্তানেরা জানত না ওরা কী করে। ঠগিরা সরকারি কর্মচারীদের ওপর চড়াও হতো না, ক্ষতি করত না কোনো সাদা চামড়ার মানুষের। এ কারণেই ওরা প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে শত শত বছর ধরে নিঃশব্দে পথচারীদের গায়েব করতে পেরেছিল।
মনে হওয়া স্বাভাবিক, ঠগিদের হৃদয়ে দয়ামায়া বলে কি কিছু ছিল না? আসল ব্যাপার তার উল্টো। নিজের ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজনের ওপর অসীম মমতা তাদের। তবু ওরা এমন পাষণ্ড হলো কী করে? কুসংস্কারই ওদের ভয়াবহ খুনি বানিয়েছে।
ঠগিদের বিশ্বাস, ওরা দেবী ভবানীর সন্তান। ভবানী মানে কালী। পুরাকালের কথা। তখন অসুর রক্তবীজের সঙ্গে কালীর লড়াই চলছে। রক্তবীজের প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে জন্ম নিচ্ছে একটা করে রাক্ষস। কালী আর কয়টা শেষ করবেন। তখন দুটি লোক এগিয়ে যায় কালীকে সাহায্য করতে। কালী তাদের এক টুকরো রুমাল (গামছা) দিয়ে বলেছিলেন, বাছা এই তোমাদের অস্ত্র। তারা ওই রুমালে ফাঁস পরিয়ে সব কটা দানবকে একে একে হত্যা করে। নতুন করে আর রক্তবীজের রক্ত ঝরে না। তাই আর রাক্ষসও জন্মাতে পারে না। কালীর জয় হয়। তিনি বলেন, বাবা রুমাল দুটি তোমরা রাখো। এগুলো দিয়েই মানুষরূপী অসুরদের হত্যা করে পৃথিবী পরিচ্ছন্ন রেখো। ঠগিরা মনে করত, তারা সবাই ওই দুজন লোকের বংশধর। ঠগিদের বিশ্বাস, তারা নিজেরা মানুষ মারে না। মা ভবানীই ঠিক করেন কে ঠগিদের হাতে মরবে। তাকে পাঠিয়ে দেন ওদের সামনে। তাই ওসব মানুষকে মেরে ফেলা ওদের দায়িত্ব। নইলে মায়ের নির্দেশ অমান্য করা হবে যে!
স্লিম্যানের হিসাব অনুযায়ী, গোটা ভারতে হিন্দু-মুসলমান ঠগিদের সংখ্যা সমান–সমান। মুসলমান ঠগিরা তাদের ধর্মের সব আচার-আচরণ মেনে চলে। সঙ্গে ভবানীকেও মানে। মানে ঠগিদের কুসংস্কার। কারণ, ঠগিদের ইতিহাস বহু পুরোনো। তখনো ভারতবর্ষে ইসলাম ধর্ম প্রসার পায়নি। সেইকালে সাতটি মাত্র আদিবাসী এই পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল। বাহলিম, ভিন, ভুজসোত, কাচুনি, হুত্তার, গানু ও তুন্দিল। নির্মূল হওয়ার আগপর্যন্ত যত ঠগি ছিল, সবার পূর্বপুরুষ এই সাতটি জাতি থেকে এসেছে। এ জন্য ঠগিরা ভারতজুড়ে বিশাল এক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সক্ষম হয়। স্লিম্যান মনে করতেন, বাইরে থেকে যতই আলাদা মনে হোক, গোটা ভারতবর্ষে ছেয়ে আছে মাকড়সার জালের মতো ঠগিদের একটিই দল। একদিন এক বন্ধুকে তিনি বলেছিলেন, ‘একবার একজন ঠগি ধরা পড়লে ওদের জালে টান পড়বে, সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে সব ঠগি।’ হয়েছিলও তাই। কল্যাণ সিং ধরা পড়ার পর মাত্র ২৬ বছরে গোটা ভারত থেকে নির্মূল হয়ে গিয়েছিল ভয়ংকর খুনির দল।
কল্যাণ সিংকে নিয়ে ঠগি শিকারে মাঠে নামেন স্লিম্যান। একটি করে দল ধরেন আর ফাঁসিতে ঝোলান। প্রতিটি দল থেকে দু-একজনকে বেছে নিয়ে রাজসাক্ষী বানাতেন। তাদের মাধ্যমেই দলের বাকি সদস্যদের খবর মিলত। তবু ওদের ধরা অত সহজ ছিল না। স্লিম্যান ঠগি ধরতে ঠগিদের পন্থা অবলম্বন করেন। ঠগি ধরার বিশাল একটা দল তৈরি করেন তিনি। তারা ব্যবসায়ী কিংবা পথচারীদের ছদ্মবেশে পথে পথে ঘুরে বেড়াত। আসলে ঠগির দলকে অনুসরণ করত। আর ঠগিরা ভাবত নতুন কোনো মক্কেল বুঝি তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে। ওদিকে স্লিম্যানের পুলিশ বাহিনী দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করত আগের দলটাকে। যে-ই দেখত ঠগিরা তাদের ফাঁদে পা দিয়েছে, অমনি তারাও এসে হাজির। গোটা দলকে ঘিরে ফেলত পুলিশ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠগিদের হাতে কড়া পড়ত।
ঠগিরা যখন ধরা পড়তে শুরু করল, তখন ওদের ভেতরে একধরনের আতঙ্ক ভর করে। ওরা বিশ্বাস করতে শুরু করে, মা ভবানী তাদের ওপর রুষ্ট হয়ে ছেড়ে চলে গেছেন। নিশ্চয়ই তিনিই স্লিম্যানকে পাঠিয়েছেন ওদের শায়েস্তা করতে। ঠগিদের এই বিশ্বাস স্লিম্যানের কাজ সহজ করে দিয়েছিল। রসন জমাদার, এনায়েত, রুস্ত খাঁ, ফিরিঙ্গিয়ার মতো দুর্ধর্ষ ঠগি সরদারকে রাজসাক্ষী বানিয়েছিলেন স্লিম্যান। তাদের মুখ থেকেই শুনেছিলেন রক্ত হিম করা ডাকাতির গল্প। সেসব গল্প লিখে রেখেছিলেন। সেগুলোই আজ ঠগিদের দুর্ধর্ষ জীবনের অকাট্য দলিল।
ঠগিদের নিয়ে অনেকগুলো বই লিখেছিলেন স্লিম্যান। হার্ড কপি বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। পিডিএফ কিনতে পাওয়া যায় অনলাইনে। কিন্তু অনেক দাম। তবে শ্রীপান্থের লেখা ‘ঠগি’ নামে বইটি বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য রত্ন। ঢাকার বড় বড় বইয়ের দোকানে এটা কিনতে পাওয়া যায়।
সূত্র: কনফেশনস অব আ থাগস, ফিলিপ মিডোস টেলর; দা থাগস অ্যান্ড ফাঁসিগর অব ইন্ডিয়া, হেনরি উইলিয়াম স্লিম্যান; ঠগি, শ্রীপান্থ।