
লক্ষ্মীর হাতে তুলে দিয়েছিলাম প্রথম পদ্য। পদ্য না ছাই। তখন তো আর ছন্দ বুঝতাম না। কবিতা বা পদ্য বলতে বুঝতাম অন্ত্যমিল। চরণের শেষে মিল রেখে লক্ষ্মীর জন্য লিখেছিলাম একটি প্রেমের পদ্য। পদ্যটি পাঠ শেষে লক্ষ্মীর চোখে-মুখে যে পুলক দেখেছিলাম, নিজেকে তখন মহাকবি মনে হয়েছিল। বাংলাদেশে এসএসসি পরীক্ষার্থী এক মহাকবি।
লক্ষ্মী তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। ওর দিদা নাম রেখেছিল লুৎফুন্নেছা। উচ্চারণটা একটু খটমটে বলে মা ডাকত লক্ষ্মী বলে। ওর মধ্যে অবশ্য নামের গুণটাও ছিল। পরিবারের সবার প্রতি ভীষণ দায়িত্বশীল। পড়াশোনা করা আর স্কুলের পাশাপাশি সময়মতো দিদার ওষুধ খাওয়ানো। সংসারে মায়ের কাজে সাহায্য করা। বাবার কাপড়চোপড় পরিষ্কার ও গোছানো। ছোট একটা ভাই আছে, তাকে পড়ানো। এককথায় পরিপূর্ণ পরিপাটি একটা মেয়ে। লক্ষ্মীর মনটাও ছিল আকাশের মতো উদার।
পাশাপাশি বাড়ি আমাদের। খুব কাছ থেকে লক্ষ্মী আর তার লক্ষ্মীয়ানা দেখে ভালোবেসে ফেলি। আমাদের কারোর বাসায় তখন টিভি ছিল না। অ্যারাবিয়ান নাইটস আলিফ লায়লা তখন জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল। বিটিভিতে রাত আটটার বাংলা সংবাদের পর প্রচারিত হতো। পাশের এক বাসায় লক্ষ্মী, আমিসহ অন্যান্য বাসার অনেকেই দেখতে আসত। সবাই যখন আলিফ লায়লায় মগ্ন, সব চোখের আড়ালে আমাদের চলত প্রেমের খুনসুটি। একদিন আলিফ লায়লা দেখে সবাই যে যার বাসায় ফিরছি। লক্ষ্মী পেছন থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। একপর্যায়ে কাঁধে ঝুলে পড়ল। লক্ষ্মীকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছি। সেদিন আকাশে মৃদু জ্যোৎস্নাও ছিল। মনে হলো আকাশ থেকে সব জ্যোৎস্না এসে আমার পিঠে লুটোপুটি খাচ্ছে। মন বলছিল, হায়! এত জ্যোৎস্না আমি কোথায় রাখি!
সপ্তাহখানেক পরেই আমাদের ভালোবাসার দৃশ্যপট পাল্টে যায়। সেদিন রাতে মৃদু জ্যোৎস্নায় পাড়ার কেউ একজন আমাদের দেখে ফেলেছিল। ঘটনার বিশদ বিবরণ পৌঁছে যায় লক্ষ্মীর মায়ের কানে। ব্যস, যা হবার তাই হলো। লক্ষ্মীর আলিফ লায়লা দেখা বন্ধ হয়ে গেল। দু-চার দিনের মাথায় লক্ষ করলাম ঘটকের আনাগোনা। এত কড়া পাহারার মধ্যেও এক রাতে লক্ষ্মী আমার পড়ার টেবিলের পাশে জানালায় এসে বলল, ‘আমার ছবি দেখে ছেলেপক্ষ পছন্দ করেছে। কাল আসছে আংটি পরাতে। তুমি যদি বলো, সবকিছু ভেঙে দিই। এ বিয়ে আমি করব না।’ রাতের বেলা লক্ষ্মীকে জানালায় দেখে এমনিতেই ভয়ে ভয়ে আছি। কে আবার দেখে ফেলে। তার মধ্যে লক্ষ্মীর সব কথা শুনে মনে হলো, চারপাশে অনেকগুলো এসি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় আমার হাত-পা হিম হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মীকে কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বাইরে কারও পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে লক্ষ্মী জানালা ছেড়ে চলে গেল। সারা রাত ভেবে ভেবে আমিও কোনো কূলকিনারা পাইনি।
দুদিন পরের কথা। লক্ষ্মী এল টিউবওয়েলে খাওয়ার পানি নিতে। পাড়ায় ডিপ টিউবওয়েল বলতে আমাদেরটাই ছিল। অনেকেই পানি নিত। লক্ষ্মী আর তার আঙুলের আংটি দেখে নিজের অক্ষমতার কথা মনে করে ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। লক্ষ্মী টিউবওয়েলের হাতল চাপছে আর পলকহীন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর চোখের ভেতর তখনো যে ভালোবাসার উপস্থিতি দেখতে পেলাম, সেখানে আংটির কোনো স্থান ছিল না।
ইব্রাহীম রাসেল
তাজমহল রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।