
‘হ্যাপিনেজ ইজ দ্য লাভ অব এ সিস্টার’ বা ‘হ্যাপিনেজ ইজ এ সিস্টার হু ইজ অলসো ইওর বেস্ট ফ্রেন্ড’—ফেসবুকের দ্য হ্যাপি পেজে বোন নিয়ে এমন অনেক সুন্দর কোট আছে। আসলে বোনে বোনে সম্পর্কই তো এমন। আর বোন যদি হয় বন্ধু তাহলে তো ষোলোকলা পূর্ণ। তবে নিখাদ ভালোবাসার এই সম্পর্কতেও কখনো কখনো ভুল বোঝাবুঝি হয়। সব সময় তা নিজেদের নিয়ন্ত্রণেও থাকে না। বিশেষ করে যখন কোনো সামাজিক রীতিনীতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় দুই বোনকে। এই যেমন বড় বোনের আগে যদি ছোট বোনের বিয়ে হয়, সেটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় বোনটির জন্য বেশ চাপের হয়ে যায়।
কিন্তু মানসিক চাপ হবে কি হবে না, সেটি নির্ভর করে পরিবার ও তার আশপাশের মানুষদের ওপর।
প্রথম আলোর ক্রোড়পত্র নকশার সুবন্ধু সমীপেষু বিভাগে নিয়মিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন নাট্যব্যক্তিত্ব সারা যাকের। তিনি বলেন, ‘পরিবার যদি ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেয় যে এসব কোনো বিষয় নয়, তাহলে তারা বুঝতে পারবে। তখন এটি কোনো সমস্যা নয়। অনেক সময় পরিবারের দিক থেকে সহযোগিতা থাকলেও পারিপার্শ্বিক নেতিবাচক আচরণের কারণে বড় বোনটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন। এটি যেমন বাস্তবিক। আবার এসব আচরণ-কথাকে গুরুত্ব না দেওয়া হলো বুদ্ধিমানের কাজ।’
হুমায়ূন আহমেদের শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসের দুই বোন রুনু ও ঝুনুর কথা মনে আছে? পিঠাপিঠি এই দুই বোনের মধ্যে ছোট বোন ঝুনুর আগে বিয়ে হয়। রুনু সেই চাপ সামলাতে না পেরে একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
বাস্তবে মানসিক ভারসাম্য না হারালেও মনোজগতে চাপ পড়ে। যেমনটা হয়েছিল শর্মিলার বেলায়। বড় বোন শর্মিষ্ঠা শর্মিলার বিয়ের পর কেমন যেন বদলে যেতে থাকেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে ভদ্রতার খাতিরে যতটুকু করা প্রয়োজন, ততটুকু করেছেন। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানের পরে প্রায় কথা বলা বন্ধ দুই বোনের। এ বিষয়ে শর্মিষ্ঠাকেই জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, ‘ও তো ইচ্ছা করলেই আমার পরে বিয়ে করতে পারত। আসলে ছোটবেলা থেকে আমাকে হারিয়ে দিয়ে আনন্দ পায়। ওর ওসব আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না। আমার তো কিছু হয়নি, তাহলে এত সহর্মমী হওয়ার কী আছে।’ শর্মিলার ব্যাখ্যা ভিন্ন, ‘আপার বিয়ের কথা হচ্ছিল অনেক দিন ধরে। এর মধ্যে আমাদের মামা একটা বিয়ের প্রস্তাব আনে আমার জন্য। প্রথম বিয়ের প্রস্তাবেই বিয়ে হয়। সেদিন থেকেই আপার আচরণ অন্য রকম। কী করব বুঝতে পারি না।’
তবে ছোট বোনের বিয়ের পর মানসিক চাপ থেকে বড় বোন অনেক সময় কর্মোদ্যম হারিয়ে ফেলে, বিষণ্নতা দেখা দেয়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। যাঁরা আগে থেকেই হীনম্মন্য তাঁদের হীনম্মন্যতা বেড়ে যেতে পারে। তখন অবশ্যই কোনো পরামর্শকের কাছে যেতে হবে। তবে এ ধরনের পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয় সে জন্য পরিবার, বড় বোন ও ছোট বোনের সমান দায়িত্ব রয়েছে।
বৃষ্টি ও বীথি দুই বোনের কথাই ধরা যাক। হঠাৎ ছোট বোন বীথির প্রেমিকের পরিবার থেকে বিয়ের চাপ আসতে থাকে। মা-বাবা বড় মেয়ের সঙ্গে কথা বললেন, তাঁর কোনো আপত্তি আছে কি না। বৃষ্টি জানান, এতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। পিএইচডি শেষ না করে তিনি বিয়ে করবেন না। বীথি বলেন, ‘শুরুতে লজ্জা লাগত। একটু অস্বস্তিও কাজ করত। আপু কী মনে করছে। পরে আপুই বিষয়টিকে সহজ করে ফেলল। বিয়ের সব কেনাকাটার সময় আপু গিয়েছে। ওর তদারকিতেই সব হয়েছে।’
এমনটিই আসলে করা উচিত মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে বিয়ের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের সময় বড় মেয়ের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিতে হবে। আবার বড় বোনটিকে সব কাজে সক্রিয় হতে হবে। তিনি যদি উদার মনের পরিচয় দেন, তাহলে ছোট বোনের জন্যও সহজ হবে সবকিছু। হঠাৎ করে ঠিক হওয়া বিয়ের ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে। কিন্তু বড় বোন যদি আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেন যে বিয়ে করবেন না তাড়াতাড়ি, তাহলে তাঁর সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করা উচিত।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, ‘সাধারণত বড় মেয়েটিকে আশপাশের মানুষের কথা শুনতে হয়। ফলে পরিবার থেকে তাঁকে যদি এমনভাবে প্রস্তুত করা হয়, যাতে যেকোনো পরিস্থিতি সামলানোর ক্ষমতা থাকে তাঁর। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এটি প্রয়োজন। আর বিয়ে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য না ভেবে নিজের কাজটা ভালোভাবে করতে হবে। পরিবারকেও উৎসাহ দিতে হবে বড় মেয়েকে।’