
সোহেলের (ছদ্মনাম) বয়স ১৫ বছর। ইদানীং তার মেজাজ অনেক খিটখিটে হয়ে উঠছে। মা–বাবার যেকোনো কথায় ঝাঁজিয়ে ওঠে! প্রায় সারা রাত জেগে থাকে। প্রতিদিনই দুপুর নাগাদ ঘুম থেকে ওঠে। মুঠোফোনের পর্দায় চোখ রেখে সব সময় মাথা নিচু স্বরে থাকে। কান থেকে ইয়ারফোন খোলে না বললেই চলে। খাবার টেবিলে বসে সাধারণত খাবার খায় না। প্লেটে কোনোমতে কিছু খাবার নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বা টিভি রুমে সোফায় বসে খায়। ধুমধাম ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। পড়ালেখায় আগের মতো আগ্রহ পায় না, দিন দিন ফলাফলও খারাপ করছে। বাসার খাবারের চেয়ে বাইরের ফাস্ট ফুডে আগ্রহ। দিন কয়েক আগে মা দেখলেন তার বাহুর ওপরের দিকে অনেকগুলো কাটা দাগ, জানা গেল সে নিজের হাত নিজে কেটেছে!
সমস্যাটা বিশ্বব্যাপী
সোহেলের মতো সমস্যা এই বয়সী অনেক ছেলেমেয়ের মধ্যেই রয়েছে। এই সমস্যা কেবল বাংলাদেশের নয়, বিশ্বজুড়েই কিশোর বয়সীদের মধ্যে কমবেশি দেখা যাচ্ছে। জাপানে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সংবেদনহীনতা এবং নিয়ম না মানার প্রবণতা বাড়ছে। একটি গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী জাপানি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অভিভাবকের কথার বিরোধিতা করার হার প্রায় ৮৫ শতাংশ। ১৫-২৪ বছর বয়সী জাপানি কিশোর ও তরুণদের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই জীবনটাকে উপভোগ করছে না।
প্রতিবেশী দেশ ভারতেও প্রায় ৫৫ শতাংশ টিনএজারদের মধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা দেখা যায়। আচরণজনিত সমস্যাও রয়েছে তাদের।
বাংলাদেশে ২০১৭ সালে পরিচালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোর–কিশোরীদের মধ্যে ৫ শতাংশের আত্মহত্যার প্রবণতা আছে, ১১ শতাংশ একাকিত্বে ভোগে, ৮ শতাংশের কোনো বন্ধুই নেই! এ গবেষণায় অংশ নেওয়া ৫৩ শতাংশ বাংলাদেশি কিশোর-কিশোরী বলেছে, ‘বাবা-মা ওদের বোঝে না।’ ৫৭ শতাংশের বাবা-মা জানেনই না তাঁদের সন্তানেরা কীভাবে অবসর কাটায়।
বয়সের পরিবর্তন মেনে নেওয়া, মানিয়ে চলা
বয়ঃসন্ধিকাল অর্থাৎ ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রত্যেক কিশোর–কিশোরীর মধ্যে মনঃসামাজিক আর শারীরিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এ সময়ে বাবা-মায়েরা সন্তানের আচরণ, পড়ালেখা, বন্ধুত্ব, আবেগ ইত্যাদি নিয়ে চিন্তিত থাকেন। কোনো বাবা-মা একটু বেশি নজরদারি করতে চান, যেটা দিন শেষে সন্তানের সামাজিক দক্ষতা বিকাশের অন্তরায় হয়ে যায়। আবার কোনো বাবা-মা যদি সন্তানকে সব দিকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে দেন, সেটাও সন্তানকে বিগড়ে দিতে পারে। এই বয়সটা একটু সামলে রাখার বয়স, একটু স্বাধীনতারও বয়স।
কখন-কী করা যেতে পারে
অনেক সময় বয়ঃসন্ধিকালে একধরনের সামাজিক উৎকণ্ঠার কারণে অপরের সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে গিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে যায় কিশোর-কিশোরীরা। তাদের আত্মবিশ্বাস কম থাকার কারণে এটি হয়। এ সময় বাবা-মায়ের দায়িত্ব সন্তানকে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক পরিস্থিতির মুখোমুখি করে দেওয়া। ছোটখাটো দায়িত্ব পালন করতে দিতে হবে। বিদ্রূপ না করে তাকে উৎসাহ দেওয়া জরুরি।
বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক পরিবর্তনগুলো যে স্বাভাবিক এবং এটা যে গ্লানির না, সে বিষয়ে ছেলে ও মেয়ে দুজনকেই আশ্বস্ত করতে হবে। এ পরিবর্তনের সময়ে সন্তানকে স্বাস্থ্যসচেতন থাকার কথা অবশ্যই বাবা-মাকে বলতে হবে। সন্তান যেন অন্যের কাছ থেকে না শোনে। এতে ভুল কিছু শেখার আশঙ্কা তৈরি হয়।
তার আবেগকে গুরুত্ব দিন
আপনার কাছে গুরুত্বহীন এমন একটি ছোট একটি বিষয় নিয়ে সে উচ্ছ্বসিত হতে পারে। তাকে নিরুৎসাহিত করবেন না, তার আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে মূল্য দিন। কোনো কারণে তার মন খারাপ হলে অযথা ‘কী হয়েছে, কী হয়েছে...’ বলে তাকে ব্যস্ত করে না তুলে তার আবেগ প্রকাশের সুযোগ দিন। কারও সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হলে রাগারাগি না করে বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করুন।
গোপন নজরদারি নয়
সন্তানের ওপর গোপন নজরদারি করবেন না, তার অনুপস্থিতিতে তার মুঠোফোন, ল্যাপটপ, ডায়েরি ঘাঁটাঘাঁটি করবেন না। তবে এ বয়সে সে মাদক গ্রহণসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে যেতে পারে, মাদকের নেতিবাচক বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করুন।
কিছু বিষয় বুঝিয়ে বলুন
সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে, তার যৌন সহিংসতার মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। পাশাপাশি সে নিজেও যৌন অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে। সে যেন যৌন নিগ্রহের মুখোমুখি না হয়, আবার নিজে যৌন নিপীড়ক হয়ে না ওঠে, সে জন্য তাকে সব ধরনের ট্যাবু থেকে দূরে রাখুন। এ জন্য তার বয়স অনুযায়ী বিজ্ঞানসম্মতভাবে যৌনতা বিষয়ে কথা বলুন।
মনে রাখবেন যৌন বিষয় না জেনে আপনার সন্তান কখনোই বড় হয়ে উঠবে না। কোনো না কোনোভাবে সে জানবেই। অবৈজ্ঞানিক আর বিকৃত পর্নোগ্রাফির ওয়েবসাইট বা অশিক্ষিত কারও কাছ থেকে এসব বিষয় জানার আগেই আপনি বিজ্ঞানসম্মতভাবে তাকে ব্যাখ্যা করলে সে নিরাপদ থাকবে। শারীরিক সম্পর্কের প্রতি কিশোর বয়সের কৌতূহল মাথায় রেখে সন্তানকে ছোটবেলা থেকেই সতর্ক করুন। যৌন নিরাপত্তার বিষয়গুলো তাকে ছোটবেলা থেকেই শেখাতে চেষ্টা করুন।
চাপ তৈরি নয়
ভালো ফলাফল বা কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যের চাপে থাকতে থাকতে সন্তানের মধ্যে তীব্র মানসিক চাপ বা স্ট্রেস তৈরি হতে পারে। তাই তার স্ট্রেস কমাতে সুস্থ বিনোদনের চর্চা, গুণগত পারিবারিক সময়ের প্রয়োজন। না হলে সে কিন্তু মাদক গ্রহণ, বিকৃত যৌন আচরণ, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদির মাধ্যমে নিজের চাপ কমানোর চেষ্টা করবে। তাই সুস্থ বিনোদনের চর্চা করার (গান, নাচ, বই পড়া, বেড়াতে যাওয়া, খেলাধুলা) এবং পারিবারিক সময় কাটানোর জন্য তাকে উৎসাহিত করুন।
পরিবারে চাই নৈতিকতার চর্চা
বাবা-মা যদি নৈতিকতার চর্চা না করেন, মানবিক গুণাবলি প্রকাশ না করেন তবে সন্তানের মধ্যে অনৈতিকতা আর বিকৃতি তৈরি হবে। ছোট–বড় সব ধরনের অনৈতিকতা থেকে বাবা-মায়ের দূরে থাকা প্রয়োজন। সন্তানের সামনে ছোটখাটো মিথ্যা বলা থেকে দূরে থাকতে হবে। বাবা-মা পেশাগত জীবনে অসৎ থাকলে সেটার ছায়া কোনো না কোনোভাবে সন্তানের ওপর পড়বেই, সন্তানের চিন্তা আর আচরণ বিকৃত, অসৎ এবং আত্মধ্বংসী হয়ে উঠবে।
না বলা শিখতে হবে
বন্ধুদের চাপে মাদক গ্রহণ ও বন্ধুদের সঙ্গে চলার জন্য ক্ষতিকর আচরণ করা থেকে বিরত থাকতে সন্তানকে ‘না’ বলা শেখাতে হবে। সন্তানকে বলতে হবে—তোমার অপছন্দের বিষয়ের প্রতি ‘না’ বলতে পারাটাই স্মার্টনেস। বন্ধুদের কাছে ‘কুল’ হতে গিয়ে মাদক গ্রহণ আর বিকৃত আচরণের চর্চা কখনোই স্মার্ট করতে পারে না।
সন্তানকে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতিসহ চারপাশে যা ঘটছে, সেগুলোর ভাবনা থেকে দূরে রাখবেন না। সেগুলোর ভালো–মন্দ সব তাকে জানতে দিন। তার সঙ্গে আলোচনা করুন। না হলে আপনার সন্তান দেশে বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন, স্বকীয় ভাবনার দিক থেকে সে প্রতিবন্ধী হয়ে উঠবে।
অপরকে সম্মান দিন
পরিবারে সবার প্রতি সম্মান দেখানোর চর্চা করুন। বিশেষ করে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য, গৃহকর্মী, অন্য কর্মচারীদের প্রতি এমন কোনো আচরণ করবেন না বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কথা বলবেন না, যাতে তাঁদের প্রতি সন্তানের আচরণও তাচ্ছিল্যপূর্ণ হয়। পরিবারের নারী সদস্যদের প্রতি কখনো এমন কোনো আচরণ করবেন না, যাতে আপনার ছেলেসন্তানটি নারীকে অবমাননা করতে উৎসাহিত হয়। পাশাপাশি ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে সবাইকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শেখান। সন্তানকে নিজ ধর্ম পালনে উৎসাহিত করুন, কিন্তু অপর কোনো ধর্ম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য বা ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যা আপনার সন্তানকে জঙ্গিবাদে উৎসাহিত করতে পারে।
কিছু অভ্যাসের পরিবর্তন জরুরি
সন্তানের রাতে জেগে থাকা আর দিনে অনেক দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস অবশ্যই পরিবর্তন করুন। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হতেই হবে। কিন্তু তাকে সময় ধরে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে দিন। প্রয়োজনে বাবা-মাকে প্রযুক্তি বিষয়ে সন্তানের চেয়ে বেশি জানতে হবে। সন্তান কোন গেম খেলে, সেটা জানুন। আপনিও প্রয়োজনে তার সঙ্গে সেই গেমটি খেলুন। লুকোছাপা করে মোবাইল বা কম্পিউটার ল্যাপটপ ব্যবহার না করার অভ্যাস তৈরি করুন। সবাই একসঙ্গে বসে খাবার গ্রহণ করুন। একা একা আলাদা খাবার অভ্যাস একধরনের ব্যক্তিত্বের সমস্যার লক্ষণ হতে পারে।
আবেগ থাক তবে বাড়াবাড়ি নয়
কিশোর বা কিশোরী সন্তান প্রেমে পড়েছে, এমনটা বুঝতে পারলে মোটেই উত্তেজিত হবেন না। প্রেমে পড়লে কেমন ভালো লাগতে পারে, সেটা বুঝে আপনার সন্তানের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করুন। তার সম্পর্কের প্রতি অতি উৎসাহী হয়ে, খুশিতে গদগদ হয়ে ‘খুব ভালো’ বা ‘উদার’ বাবা-মা হওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। মনে রাখতে হবে আপনার সন্তানের বয়স খুব বেশি নয়, সুতরাং তার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর আগে সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করুন। তবে হঠাৎ করে রেগে গিয়ে তার সম্পর্কটি এই মুহূর্তেই শেষ করে ফেলতে হবে, এমনতর আদেশ বা হুমকি তাকে দেবেন না।
অনেক সময় টিনএজ সন্তানের বেশ কিছু বিষয় যেমন আবেগের অস্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ (বেশি বেশি রাগ করা বা সব সময় মন খারাপ করে থাকা), আচরণের পরিবর্তন, মাদক গ্রহণ, পশুপাখির প্রতি নির্দয় আচরণ, পরিবারের সদস্যদের শারীরিকভাবে আঘাত করা, সারা রাত জাগা আর সারা দিন ঘুমানো মানসিক সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। এই বিষয়গুলো সন্তানের মধ্যে দেখা গেলে প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।