মনেরবাক্স

বুঝতে পারা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমার বয়স তখন অল্প। আমি ছোট থেকে বেড়ে উঠেছি এক অন্য রকম পরিবেশে। মা-বাবা আর ঠাম্মা ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। ছিল না কোনো ভাইবোন বা খেলার সাথি। তবে আমার বাবা ছিলেন আমার কাছে সব। তিনি আমাকে সব সময় জুতো পরার কথা বলেতেন। অত জুতো পরতে কি ইচ্ছা করে! বাবার চোখ শুধু আমার পায়ের দিকে। বাবা শুধু বলেন, ‘জুতা কই, জুতা কই, জুতা কই?’ কান ঝালাপালা হয়ে যায় শুনতে শুনতে। অত জুতা পরলে আমার পা জ্বালা করে। তবে জুতা আমার খুব অপছন্দের ছিল। আমার খুব ইচ্ছা করে খালি পায়ে হাঁটতে, দৌড়াতে, খালি পায়ে জলে গিয়ে ভিজতে, মুখ ভেজাতে, হাত ভেজাতে, মাথা ভেজাতে, পুরো শরীর ভেজাতে। কী যে আনন্দ!
কী মিষ্টি এক শীতের রাত, আমি লেপের ভেতর মাকে জড়িয়ে শুয়ে আছি, ভোর হয়ে এসেছে আমার ঘুম ভাঙেনি, ঘুম ভেঙে গেছে বাবার!
বেশ অবাক কাণ্ড! আমার আগে বাবা কখনো ওঠেন না, প্রতিদিন তো আমিই বাবাকে ডেকে ডেকে ওঠাই। তাহলে আজ এমন হলো কীভাবে?

কিছুক্ষণ পর বাবা আমাকে ঠেলা দিয়ে বললেন, ‘যাবা?’

আমার ঘুমটা ছিল তখন কাচের পেয়ালার মতো, একটু হাত লাগলেই ভেঙে চৌচির।

আমি চোখ খুলে বললাম, ‘যাব।’ অমনি লাফ দিয়ে উঠলাম।

মা বললেন, ‘ওকেও কি নিয়ে যাবা?’

বাবা বললেন, ‘হুম।’

আমি তো বেশ খুশি, এত সকালে কখনো যাইনি বাইরে। বাবা আমাকে একটা মোটা কাপড় পরালেন। আমি দৌড়ে গেলাম জুতা নিতে। বাবা বললেন, ‘আজ জুতা লাগবে না।’

আমার তো খুশির শেষ নাই। বাবা আমাকে বলছেন জুতা লাগবে না। এটা তো আমার কাছে এভারেস্ট জয় করার মতো বিষয়। আমার মনে হলো বাবা আমার কষ্ট বুঝেছেন। বাবাও দেখি জুতা পরেননি!

তারপর আমরা বের হলাম। একটা রিকশা নিলাম, কিছু সামনে গিয়ে দেখি রিকশা আর এগোতে দেবে না। আমরা তখন হাঁটা ধরলাম খালি পায়ে। দেখি আরও অনেক মানুষ। এ কী, কারও পায়ে জুতা নেই! আমার বেশ অন্য রকম লাগল।

কুয়াশাভরা রাজপথ আর এত লোক, আমি কখনো এত মানুষ একসঙ্গে দেখিনি। কারও পায়ে জুতা নেই। আমার পায়ে নেই, বাবার পায়ে নেই, সামনের লোকটির পায়ে নেই, পেছনের লোকটির পায়েও নেই!

কেমন আস্তে আস্তে এগোচ্ছে সবাই, সবার মুখে শুনি কেমন একটা গান, সবাই সুর করে গাচ্ছে!

সবার হাতে দেখি ফুল। বাবাও দেখি কোথা থেকে একটা ফুল বের করলেন, আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।

আমি শুনছি সবাই যেন কোনো ভাই হারানোর কথা বলছে, সবাই যেন রক্তের কথা বলছে। এত মানুষের ভাই হারিয়েছিল এক দিনে? এত মানুষ রক্ত দিয়েছিল এক দিনে? আমার বেশ ভয় লাগে। আমার মাথায় বেশ কয়েকটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

এ কী, বাবাও দেখি গানটি গাচ্ছেন! তাহলে কি বাবারও ভাই হারিয়েছিল এই দিনে, বাবার ভাইও কি রক্ত দিয়েছিল এই দিনে?

বাবা আমাকে বললেন, ‘গান গাও।’

কিন্তু আমার তো কোনো ভাই নাই, আমি তো কারও ভাইও নই, আমার তো কেউ রক্তও দেয়নি। কারা ছিল এত মানুষের ভাই? সবাই দেখি গাইছে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি, আমি কি ভুলিতে পারি!’

আমিও গাইতে লাগলাম, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...।’

আমার মনে হাজার প্রশ্ন ঘুরছে—কারা হারিয়ে গেছে, কারা রক্ত দিচ্ছে, কাদের জন্য আমরা খালি পায়ে হাঁটছি, কাঁদছি?

আমি তো অত ভালো হাঁটতে পারি না, আস্তে আস্তে রাস্তার পাশ দিয়ে চলছি, দেখছি রাস্তায় অনেকে সারি বেঁধে চলছে, কী সুন্দর লাগছে তাদের! কোথা থেকে বাবা যেন একটা কালো ফিতা এনে আমাকে পরায়ে দিলেন।

এ কেমন দিন এল! এত মানুষের দিন, এত ফুলের দিন, কালো ফিতার দিন, ভাইয়ের জন্য কাঁদার দিন? এ দিন কি আগে কখনো আসেনি, নাকি বাবা আমাকে কখনো এ দিন দেখতে দেননি?

আমি আর হাঁটতে পারছি না, বাবা আমাকে অনেকক্ষণ কোলে নিয়ে হাঁটলেন, মজাও হলো। একটু এগোতেই দেখি একটা লাল বড় সূর্য। কী বড় সূর্যটা! সবাই দেখি সূর্যটার সামনে ফুল রাখছে, কত ফুল, ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে চারপাশ। আমি এত ফুল এর আগে কোথাও দেখিনি। আরেকটু হলে ফুল দিয়ে সূর্যটা ঢেকে যাবে। লাল টকটক সূর্য ডুবে যাবে হলুদ, লাল, নীল, ফুলের ভেতর। সারি বেঁধে ফুল রাখছে সবাই।

আমি আর বাবা সেই লাল সূর্যটার দিকে এগোতে লাগলাম। আমি কি ভুলিতে পারি, আমি কি ভুলিতে পারি বলতে বলতে ফুলটা রাখলাম সেই সূর্যটার কাছে। বাবাও তার ফুলটা রাখল সেই সূর্যের পায়ের নিচে, মনে হলো সূর্যটা একটা বিশাল বড় ফুল, যার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে।

এসব দেখে আমার বুক কাঁপছে, আমার মনে হাজারটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, আমাকে অন্য রকম লাগছে, চোখ ফেটে জল বেরোতে চাচ্ছে। এত মানুষ, এত ফুল, এত বড় লাল সূর্য আমি আগে দেখিনি। এ আমি কী দেখলাম? এ কি স্বপ্ন?

আমি বাড়ি ফিরে এলাম, আমার বুক এখনো কাঁপছে, আরও বেশি করে কাঁপছে। আমি বাবাকে বললাম, বাবা আমাকে অনেক কিছু বলল। আমার মনে হলো আমি আর আমি নাই, আমার বুক আরও বেশি করে কাঁপতে লাগল। আমি অনেক কিছু ভাবতে থাকলাম। আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। আমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরি, আমি কেঁদে ফেলি, মা-ও কেঁদে ফেলেন।

আমার মনে একটা গানই বাজছে, ‘আমি কি ভুলিতে পারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’

চিত্ত ভানু, দিনাজপুর

লেখাপাঠানোরঠিকানা

অধুনা, প্রথম আলো, সিএ ভবন, ১০০ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।

ই-মেইল: adhuna@prothom-alo.info ফেসবুক: facebook.com/adhuna.PA.

খামের ওপর ও ই-মেইলের subject-এ লিখুন ‘মনের বাক্স’