আইন অধিকার

বয়স এখন ১৮

কবি সুকান্তর ভাষায়, আঠারো বছর বয়সে স্পর্ধায় মাথা তোলবার ঝুঁকি নেওয়ার কথা রয়েছে। আবার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের ভাষায় আঠারোই হলো অধিকার দাবি করে মাথা তোলার সময়। বয়স ১৮ পূর্ণ মানেই হলো শিশুর আওতা থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ণবয়স্কের মর্যাদা পাওয়া। আন্তর্জাতিক আইন তা-ই বলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করে দেশের আইনেও ১৮ বছর হলে সাবালক হওয়ার স্বীকৃতি দিয়েছে।

আমাদেরও আছে অধিকার। মডেল: তাহমিদ ও হৃদিতা ছবি: অধুনা
আমাদেরও আছে অধিকার।  মডেল: তাহমিদ ও হৃদিতা ছবি: অধুনা

কী অধিকার ১৮ হলে
১৮ হওয়া মানে আইন অনুযায়ী তিনি একজন পূর্ণবয়স্ক নাগরিক। রাষ্ট্র তাঁকে তাঁর ভোট দেওয়ার ক্ষমতা দেয়। জাতীয় পরিচয়পত্র বা স্মার্টকার্ড ইস্যু করা হয় তাঁর নামে। নাগরিক হিসেবে তাঁর সব অধিকার কিংবা দায়-দায়িত্ব তাঁকে অর্পণ করা হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাংকে নিজের নামে অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সেবা গ্রহণের অধিকার তাঁর জন্মায় স্বাধীনভাবে। আর সন্তান হিসেবে তিনি তখন সাবালক। তাই তাঁর নিজের অধিকার সম্পর্কে নিজেই মতামত নিতে পারেন। বিয়ে, চাকরি, পড়াশোনা প্রভৃতি বিষয়ে নিজে আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিলে তা বৈধ। তবে বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলেদের কিন্তু ২১ বছর হতে হয়। মা-বাবাকে তখন বুঝতে হয়, সন্তানের আইনগত সত্তার এবং মতামতের গুরুত্ব দিতে হয়। আইনের চোখে তখন সন্তান তো একজন বৈধ নীতিনির্ধারকও।
যে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়
সন্তানের নামে জমি থাকলে তা আঠারোতেই সন্তানকে হস্তান্তর করতে হবে। সন্তান দাবি করলে অস্বীকার করা যায় না। সন্তানও যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যেহেতু আইন অনুযায়ী তিনি এখন মালিক। তাঁকে ত্যাজ্যও করা যাবে না। আইন সমর্থন করে না। বিয়ের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের মেয়ে নিজের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাঁকে তাঁর নিজের বিয়ের সিদ্ধান্তের জন্য মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করা যায় না। এমনকি কোথায় থাকবেন না থাকবেন-এ সিদ্ধান্তও তাঁর। আবার মা-বাবা আলাদা থাকলে বা মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গেলে ১৮ বছরের সন্তান কার কাছে থাকবেন-এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার পান। তখন মা কিংবা বাবা তাঁকে হেফাজতে নিতে বা অভিভাবকত্ব চেয়ে আদালতেও যেতে পারেন না কিংবা গেলেও লাভ হয় না। এমনকি নিজে আলাদা বসবাস করারও অধিকার পান। পেশা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
যা মানতে হয়
তাই বলে বয়স ১৮ হলে কি যা ইচ্ছা তা করা যায়? এর উত্তর হচ্ছে ‘না’। চাইলেই যা ইচ্ছা করা যায় না। তখন আইনি বাধ্যবাধকতার আওতায় চলে আসে। যেমন ১৮ বছরের আগে যদি কেউ কোনো অপরাধ করে তা শিশু আইনে বিচার হলেও এবং কিছু সুযোগ-সুবিধা পেলেও, ১৮ হলো মানেই দেশের অন্যান্য নাগরিকের যে আইন মানতে হবে, তাঁকেও সে আইনের আওতায় আসতে হবে। মাদকে অভ্যস্ত হলে, নারী নির্যাতন করলে কিংবা অন্য যেকোনো বেআইনি কাজ করলে তাঁকে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির মতো শাস্তি পেতে হবে।

আর একটা বিষয়, প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবার মতামতকে একদম উড়িয়ে দিলে চলবে না। আইনের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতাবোধও পাকাপোক্ত থাকতে হয়। নাবালক সন্তান যেমন মা-বাবার কাছ থেকে ভরণপোষণ পায়, তেমন করে সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে বয়স্ক এবং কর্মহীন বাবা-মাকে উল্টো ভরণপোষণ দিতে হবে। না দিলে কিন্তু আইনে শাস্তি আছে।

এ ক্ষেত্রে শুধু ১৮ হলেই হয় না, কর্মক্ষমতা অর্জন করতে হয়। তাই ১৮ হলেই এত দায়-দায়িত্ব নিতে হবে, তা কিন্তু নয়। স্বাবলম্বীও হতে হয়। তাই বলে এই না যে ১৮ হলে স্বাবলম্বী হতেই হবে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট আর শিক্ষাব্যবস্থার কারণে তা সম্ভবপরও নয়। তবে এ বয়সের কেউ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। শ্রমিক, চাকরিজীবী কিংবা উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। মনে রাখা চাই, নাগরিক অধিকার যেমন ১৮-তে আসে, তেমনি আইনি যত সব বাধ্যবাধকতা ১৮ পূর্ণ হলেই মানতে হবে। এর ব্যত্যয় করা চলে না।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট