ঈদ অণুগল্প: ২য় সেরা

ভয়

ভয়
ভয়

: আব্বু, তুমি ‘আইত্তা’ বলো কেন? বলবা ‘আচ্ছা’।
: আচ্ছা। এখন থেকে আর ভুল হবে না।
: ঠিক আছে।
আমার তিন বছরের মেয়েটাকে নিয়ে সমস্যা হয়েছে। ও ছোটকালে যে কথাগুলো বলত, এখন আমি সে কথাগুলো হুবহু বলতে গেলেই সমস্যা। মেয়ে আমাকে শুদ্ধটা শেখাবে। আর আগের অশুদ্ধ উচ্চারণটার জন্য আমাকে কটাক্ষ করবে, নাক সিটকাবে। সেদিন ওর আম্মুকে বলছে—
: আম্মু, আব্বু কুকুরকে ‘তুতুর’ বলে কেন? আমি কি বলি?
: না, আমার আম্মু ‘তুতুর’ বলে না।
: আমার আব্বু কিচ্ছু বুঝে না। তাই না আম্মু?
: হ্যাঁ। তোমার আব্বু আসলেই কিচ্ছু বোঝে না।
জন্মের সময় ওর গায়ের রং হয়েছিল ফরসা, ঠিক ওর মায়ের মতো। চেহারাও তা-ই। আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার মেয়ে হবে ঠিক আমার মতো। দেখতে, শুনতে এবং আচরণে। কিন্তু উল্টোটা আমার মন মেনে নিতে পারেনি। অবশ্য কিছুদিন পর ধীরে ধীরে গায়ের রং এবং চেহারার আদল পরিবর্তিত হতে শুরু করল। পরে দেখা গেল, সবকিছুই পেয়েছে আমার মতো করে। এখন তো যে কেউ দেখলেই বলে, মেয়ে হয়েছে ঠিক বাপের মতো। দেখতে, শুনতে এবং আচরণে।
আমার মেয়েটা সব সময় আমার জন্য পাগল থাকে। কোথাও প্রকাশ্যে বের হওয়ার উপায় নেই। ওকে সঙ্গে নিতেই হবে। অফিস থেকে ক্লান্ত দেহে যখন বাড়ি ফিরি, ও যদি দূর থেকে আমাকে দেখে, এত জোরে দৌড় দেয় যে আমি ভয় পেয়ে যাই, এই বুঝি ধপাস করে পড়ে যাবে। আমার জন্য কেউ পথ চেয়ে অপেক্ষা করে না, শুধু আমার মেয়েটি ছাড়া। শুনেছি, বাবার জন্য মেয়েরাই নাকি পাগল হয় বেশি। তাই বলে এতটা!!মাঝেমধ্যে রাগ হয়, মন চায় কষে একটা চড় দিই। কিন্তু পরক্ষণেই ধৈর্য ধরে ফেলি, মাথা ঠান্ডা করি। নিষ্পাপ মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে অস্থির আত্মা শান্ত করি। ওর মধ্যে আমি আমার মাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করি, আমার দুরন্ত শৈশবের ছায়া দেখতে চেষ্টা করি।মিষ্টি সকালে সূর্যের রোদ আমার ঘরে প্রবেশ করে। আমার মেয়েটা তখন জেগে ওঠে। আমাকে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করে। আমার চোখে- মুখে-মাথায় কোমল হাত বুলিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠতে বলে। কোন পাষাণ বাপ তখন ঘুমিয়ে থাকতে পারে? অন্তত আমি পারি না। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আমি যদি কখনো ওকে ধমক দিই, ও আশ্চর্য রকম শান্ত ও নির্বাক হয়ে পড়ে। জলভরা অভিমানভেজা চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার বুকটা তখন মুহূর্তে শূন্য হয়ে পড়ে। আমি আর আমার মধ্যে থাকি না। আমি আমার পচা মেয়েটাকে ছোঁ মেরে বুকে তুলে নিই।আমারও হয়তো তখন চোখের কোণে অশ্রু জমে। মরার অফিসে সেদিন আর যাওয়া হয়ে ওঠে না আমার। নানান কথা বলে ওর মন ভোলাতে চেষ্টা করি, ওকে হাসাতে চেষ্টা করি। অনেক সাধনার পর ও যখন হেসে ওঠে, তখন মনে হয়, আমিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানুষ। আমার কোনো দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, থাকতে পারে না। আর মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, এ মেয়েটাকে যে করেই হোক মানুষ করতে হবে। অন্তত ওর জন্য হলেও এ নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে।আমার মেয়েটার কদিন পর পর জ্বর আসে। এ জন্য হাসপাতালে সাত-আট দিন থাকতে হয়েছিল। প্রথম দিন ডাক্তার ওর হাতে ইনজেকশন পুশ করেছিল। আমার মেয়ের বুকফাটা আর্তনাদে আমার হূদয় বিদীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেদিন আমিও ওর সঙ্গে কেঁদেছিলাম। আমারও পোড়া চোখে সেদিন জল ঝরেছিল।আমার মেয়েটা অ আ লিখতে পারে; ১, ২-ও লিখতে পারে। ওর হাতের ওপর হাত রেখে যখন আমি অ আ লিখে দিই, তখন ও বলে—আব্বু, তুমি কিচ্ছু পারো না। ও বিরক্ত হয়ে নিজে নিজেই অ আ লিখে আমাকে দেখায়। আর বলে, দেখেছ! সুন্দর হয়েছে না? আমি বলি, হ্যাঁ, খুব সুন্দর হয়েছে। পরাজয় কখনো কখনো এত মধুর, এত আনন্দের, এত গর্বের হতে পারে, তা আগে আমার জানা ছিল না।

আমার মেয়েটা আমাকে ছাড়া শোবে না। অন্য কারও সঙ্গে ও ঘুমাবে না। ঘুমানোর আগে গল্প বলতে হবে। প্রথম প্রথম ‘বাবুর গল্প’ বা ‘কুকুরের গল্প’ বলে নিস্তার পাওয়া যেত। কালক্রমে এগুলো পুরোনো বাসি হয়ে গেল। আমার ছোট বোনের মুখে একদিন ও কাঠুরিয়ার গল্প শুনল। ব্যস, শুরু হয়ে গেল কাঠুরিয়ার গল্প শোনার জন্য আবদার। প্রতিদিন রাতে একটা না একটা কাঠুরিয়ার গল্প ওকে বলতেই হবে। কত আর বানিয়ে বলা যায়। খাওয়ানোর সময় সমস্যা করে আরও বেশি। নিজের হাতে খাবে না। ওকে খাইয়ে দিতে হবে। ‘আচ্ছা, তো আম্মুর হাতে খাও।’ না, তা হবে না। আমাকেই খাইয়ে দিতে হবে। আমি ব্যস্ত মানুষ। নিজেই খাওয়ার সময় পাই না। ওকে খাওয়ানোর সময় কোথায় আমার? খেতে বসালেও সমস্যা। কাঠুরিয়ার গল্প  শোনাতে হবে, নইলে সে খাবে না।

সমস্যার শেষ এখানেই নয়। আরও আছে। বাথরুমে ও আমাকে ছাড়া যাবে না। ওর গোসলটাও আমাকেই করিয়ে দিতে হয়। বাথরুমে বসানোর পর প্রায়ই ও চিৎ কার করে ওঠে—আব্বু, ভয় দেখানো! ভয় দেখানোর ব্যাপারটা একটু ভেঙেই বলি। ওর আম্মু বাথরুমে নিজের পা ঘষামাজার জন্য মাটির তৈরি একটা অদ্ভুত জিনিস কিনেছে। পায়ের তালু পরিষ্কার করতে এটি কাজে লাগে। জিনিসটি হাতে ধরা যায়। চ্যাপ্টা আকারের। বাইরের দিকটা কাঁঠালের চামড়ার মতো অমসৃণ। কেন যে আমার মেয়েটা এ অদ্ভুত জিনিস দেখে ভয় পায়, বুঝি না। এটা দেখলেই সে বলে উঠবে—আব্বু, ভয় দেখানো! আমি তখন তাড়াতাড়ি এটা সরিয়ে ফেলি। আসলে নামটা ওর মায়েরই দেওয়া। এ যন্ত্র দিয়ে ভাত খাওয়াতে সুবিধা। খাবার খেতে না চাইলে ওর মা যন্ত্রটিকে সামনে নিয়ে আসে। এতে কাজ হয়। ভয় দেখানোর অদৃশ্য ভয়ে সে তাড়াতাড়ি সম্পূর্ণ খাবার খেয়ে ফেলে।

এ সবই অনেক আগের কথা। এত দিনে ও নিশ্চয় অনেক বড় হয়ে গেছে। লন্ডনের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বড় মাপের মানুষ হবে ও—এটা ভেবে ভালোই লাগছে। ও বেঁচে থাকুক আনন্দের মাঝে, সমৃদ্ধির মাঝে। কোনো রকম কষ্ট যেন আমার মেয়েকে স্পর্শ না করে। দিনরাত শুধু এটাই কামনা করি।

না, কোনো রকম আইনি লড়াইয়ে যাইনি আমি। নষ্ট মোহে সর্বনাশা সুখের আশায় ওর মা আমার কাছ থেকে চলে গেছে দূরে, বহু দূরে। আশার বাসায় যখন পাখিই থাকে না, তখন তার ডিম রেখে কী হবে? মেয়েটা ওর মায়ের বুকজুড়ে থাকুক, ক্ষতি কী? স্মৃতিটুকু শুধু আমারই থাক।

গভীর রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠি। অন্ধকারে বেডসুইচ টিপে আলো জ্বালি। আমার মেয়েটার অমঙ্গল আশঙ্কায় ভয়ে শিহরিত হই। দূর থেকে আমার মেয়ের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর আমার কানে বাজে—

‘আব্বু, ভয় দেখানো।’

রামপুরা, ঢাকা।