
বয়স তখন সাত কি আট হবে। চোখের সামনে খুব কাছের এক বন্ধুর চলে যাওয়া দেখেছি। খুব সাহসী ছিল সে। ওইটুকু বয়সে উত্তাল ব্রহ্মপুত্রে সাঁতার কাটত। গাছে গাছে চড়ে নানা ফল এনে আমাদের খাওয়াত। আমরা বহুবার নিষেধ করেছি, সে শুনত না। ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে গিয়ে কত যে দুষ্টুমি করত সে। একটা মাছ তার বড়শিতে ঠোকর দিলেই হইচই করে লাফিয়ে উঠত।
কুকুর, বিড়ালের সঙ্গে ভীষণ সখ্য ছিল। আমরা দেখতাম কুকুরকে ঘোড়া বানিয়ে তার ওপর সওয়ার হতো। সারা দিন কুকুরের সঙ্গে বাড়িতে গড়াগড়ি খেলত। আমরা বন্ধুরা অনেক বারণ করতাম, সে শুনত না।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখি, তাদের বাড়ির সামনে জটলা। কাছে যেতেই দেখি, আমার বন্ধুটিকে শিকল পরিয়ে রাখা হয়েছে। সে কুকুরের মতো আচরণ করছে। যাকে সামনে দেখছে তাকেই কামড়াতে আসছে। আমি সাহস করে তার সামনে গেলাম, মনে হলো যে আমাকে চিনতে পারল। মায়াকাড়া চোখে অপলক তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ থেমে আবার শুরু করল তার পাগলামি। আমার বন্ধুর শিকল পরানো সেই হাত দুটো এখনো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। যে হাত দিয়ে পেয়ারা, বরই, নাশপাতি এনে খাওয়াত, সেই হাতে শিকল পরানো দেখে সারা রাত ঘুমাতে পারিনি।
পরদিন স্কুলে যাওয়ার পথে তাকে দেখে গেলাম। অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ। কিছুই খেতে পারে না। স্কুল থেকে ফেরার পথে ভাবছি, আরেকবার তাকে দেখে যাব। জিজ্ঞেস করব, ‘বন্ধু, তুই কেমন আছিস?’
তাদের বাসার সামনে এসে দেখি, বন্ধুর নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে আছে। এখন আর শিকল দিয়ে হাত বাঁধা নেই। এখন সে মুক্ত, এখন সে স্বাধীন। সেই মুখ, সেই চঞ্চলতা আজও ভুলিনি। বন্ধুটির কথা একটুও ভুলে থাকতে পারিনি।
এরপর অনেকের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হলো, অনেকে এল-গেল, অনেকে ভুল বুঝে দূরে থাকে। কিন্তু সেদিনের আমার বন্ধুর অভিমানী মুখটা এতগুলো বছর পর আজও সেই শৈশবের মতোই উজ্জ্বল। বন্ধু, তুই যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস।
মো. মফিজুল হক, ঢাকা।