সরস রচনা

ভূমিকম্পের ভোরে

আঁকা: রাকিব
আঁকা: রাকিব

ভূমিকম্পের প্রথম ঝাঁকুনিতেই আমার বউয়ের ঘুম ভেঙে গেল। সে সঙ্গে সঙ্গে ভূমিকম্পের তালে তাল মিলিয়ে আমাকে ধাক্কা মেরে বলল, ‘বাবা রে বাবা, ঘুমের মধ্যে এমন নড়াচড়া করে! মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে!’
এতক্ষণ আমিও সন্দিহান ছিলাম, আসলেই ভূমিকম্প হচ্ছে কি না। ওর কথা শুনে নিশ্চিত হলাম। লাফ দিয়ে খাট থেকে উঠেই চিত্কার করে বললাম, ‘তাড়াতাড়ি ওঠো! ভূমিকম্প হচ্ছে, দ্রুত নিচে নামতে হবে।’ আমি খাট থেকে নামার পরও খাট যখন নড়ছে, তখন আমার বউ নিশ্চিত হলো এটা সত্যি সত্যি ভূমিকম্প। সে-ও খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে চেঁচিয়ে বলল, ‘বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন! যাও, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও!’
আমি বললাম, ‘রেডি হব মানে কী! তাড়াতাড়ি নামো।’ ও দৌড়ের মধ্যেই বলল, ‘তুমি লুঙ্গি পরে নিচে যাবা নাকি! যাও, প্যান্ট পরে আসো। কতবার বলছি, লুঙ্গি না পরে রাতে ট্রাউজার পরে ঘুমাও। যাও, ততক্ষণে আমি রেডি হয়ে নিই।’
সময়টা এমন, আশ্চর্য হওয়ারও সময় নেই! তাই আর কিছু না বলে প্যান্ট খুঁজতে লাগলাম। চট করে বুদ্ধি খাটিয়ে মোবাইল ফোন আর আধা লিটার পানিও সঙ্গে নিয়ে নিলাম। কোনো কারণে ভেতরে আটকে পড়লে যেন কয়েক দিন টেকা যায়, সে ব্যবস্থা করে রাখা ভালো। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম, বিস্কুটের প্যাকেট আছে কি না, কিছু শুকনা খাবার সঙ্গে থাকা খারাপ হবে না। এর মধ্যে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমার আগেই আমার বউ রেডি হয়ে গেছে। চিত্কার করে বলছে, ‘তুমি প্যান্ট না পরে হাতে নিয়ে দৌড়াচ্ছ কেন? তাড়াতাড়ি করো!’
আরও কয়েক দফা এ রুম-ও রুম করার পর নিরুপায় হয়ে বললাম, ‘শোনো, তুমি নিচে নেমে যাও, আমি একটু পরে আসছি।’ কিন্তু সে আমাকে ছাড়া যাবে না। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, সে কেনাকাটার জন্য মার্কেটে যাচ্ছে, আমাকে ছাড়া কোনোভাবেই যাওয়া যাবে না! আমি করুণভাবে বললাম, ‘অবস্থা ভালো না, যেকোনো সময় দালান ভেঙে পড়তে পারে!’
সে বিকট চিত্কার করে বলল, ‘প্যান্টটা পরে এক্ষুনি বের হও।’ আমি মিনমিন করে বললাম, ‘প্যান্ট যে পরব আন্ডারওয়্যারই তো খুঁজে পাচ্ছি না।’ বউ আমার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘প্যান্ট পরতে হবে না, লুঙ্গি পরেই চলো।’
তারপর পড়িমরি করে আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলাম। ভূমিকম্পের রেশ তখনো আছে। নামার পরই মনে হলো, নেমে বিরাট বোকামি করে ফেলেছি। চিকন একটা রাস্তার দুই পাশে বিরাট বিরাট দালান, ভেঙে পড়লে সরাসরি গায়ের ওপর এসে পড়বে। এর চেয়ে বাসায় বেশি নিরাপদ ছিলাম। আশপাশে বড় কোনো ফাঁকা জায়গা আছে কি না চিন্তা করতে করতেই ভূমিকম্প থেমে গেল। কিন্তু বড় ভূমিকম্পের পর আবারও ভূমিকম্প হতে পারে, এ চিন্তায় সবাই এখনো রাস্তায়। আমাদের দালানের অন্য নারীরা আমার বউয়ের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার বউয়ের মতো তারাও যদি একটু চুলটুল ঠিক করে আসত—এই ভেবে হয়তো কেউ কেউ দীর্ঘ নিশ্বাসও ফেলল। এদিকে লুঙ্গি পরিহিত আমি বেশ ভারিক্কি একটা ভাব নিয়ে অনুতাপ ঢাকার চেষ্টা করছি। এমন সময় এক তরুণী বিরক্তিমাখা গলায় বলল, ‘দূর, সবকিছুর পূর্বাভাস পাওয়া যায়, ভূমিকম্পের বেলায় সমস্যা কী! পূর্বাভাস পাওয়া যায় না কেন! বিজ্ঞানীরা করেটা কী! আজব!’
পাশের ফ্ল্যাটের এক চাচা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘পূর্বাভাস না দেওয়াই ভালো।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন?’
চাচা বললেন, ‘পূর্বাভাস পাওয়া যায় নাই বলে ঘণ্টা খানেক রাস্তায় দাঁড়িয়ে পার পেলাম, পূর্বাভাস পেলে টিভি চ্যানেলগুলোর কল্যাণে সন্ধ্যা থেকেই রাস্তায় থাকতে হতো!’
উত্তরে কিছু বলার মতো পেলাম না। কথা তো ঠিক। লুঙ্গিতে কষে একটা গিঁট দিয়ে বউকে বললাম, ‘চলো, এবার ওপরে যাই!’ বউ ভোরের আকাশের দিকে তাকিয়ে মোলায়েম গলায় বলল, ‘আহ্, মাঝে মাঝে এ রকম ভূমিকম্প হওয়া ভালো। এই ভোরে ভূমিকম্প না হলে কি প্রতিবেশীদের সঙ্গে এভাবে দেখা হতো...!’