
দেয়ালে ফুটে আছে ফুল, বসে আছে ময়ূর। ইট-পাথর, সিমেন্টের পলেস্তারা নয়, কাদামাটির দেয়ালেরই এমন শোভা। কোনো শিল্পীর আঁকা নয়, বাড়ির বউদের হাতের তুলিতেই এমন রাঙা হয়ে উঠেছে মাটির দেয়াল। এই দেয়ালঘেরা বাড়ির দিকে তাকালেই মনে হয়, একটু বসে যাই। ইলা মিত্রের স্মৃতিধন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলে মাটির ঘরের এই দৃশ্য পুরো এলাকারই সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। ঘর হবে মাটির আর দেয়ালে থাকবে না হাতে আঁকা আলপনা, এ যেন কল্পনাও করতে পারে না এই অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবারগুলো। দারিদ্র্যকেও যেন জয় করেছে এই দেয়ালশিল্প। কারণ, একটি হতদরিদ্র পরিবার, অন্ন জোগাড় ছাড়া অন্য চিন্তা মাথায় আসার কথা নয় যাঁদের, তাঁদের ঘরও শোভা পাচ্ছে এমন অপরূপ আলপনায়।
গ্রামের নাম টিকইল। এঁকেবেঁকে গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। দুই ধারে সারি সারি বাড়িগুলো সবই প্রায় কাঁচা। ছোট-বড় সব ধরনের বাড়িই মাটির দেয়ালে গড়া। বাইরে থেকেই বাড়ির দেয়ালগুলো পথচারীর নজর কাড়ে। সব দেয়ালেই রয়েছে রঙের আলপনা। বাইরে থেকে কোনো শিল্পী এনে এই আলপনা করা হয়নি। তাদের ঘরে ঘরেই রয়েছে এই আলপনাশিল্পী। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি এসে সব মেয়েরা আলপনাশিল্পী হয়ে ওঠেন। কেউ কেউ মাকে দেখে শিখেছেন। আবার কেউ শ্বশুরবাড়ি এসে দেয়াল রাঙানোকে গেরস্থালির অংশ হিসেবে নিয়েছেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে ২৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থান নাচোল উপজেলার টিকইল গ্রামের। গ্রামটি তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী ইলা মিত্রের স্মৃতিধন্য নেজামপুর ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে। ১২ অক্টোবর নেজামপুর ইউনিয়নের হাটবাকইল বাজার থেকে উত্তর দিকের রাস্তা ধরে যেতেই চোখে পড়ে মাটির দেয়ালঘেরা সারি সারি বাড়ি। আর তার গায়ে আঁকা আলপনা।
একটি বাড়ির সামনে না থেমে আর যাওয়া গেল না। বাড়িটি খুবই ছোট। পরে জানা গেল বাড়ির মালিক দাসু চন্দ্র বর্মন একজন দিনমজুর। বাড়ির সামান্য ভিটেছাড়া তার আর কোনো জায়গাজমি নেই। এই ভিটেতেই তাঁর মাটির ঘর। দেয়াল-মেঝে সবই মাটির। কিন্তু বাড়ির দিকে চোখ পড়লেই যেকারও মনে হবে হাতে সময় থাকলে বাড়িতে একটু বসে যাই।
পাশের গোসাইপুর গ্রামের যুবক আবু বাক্কার হাটবাকইল বাজার থেকে সঙ্গী হয়েছেন। বোঝা গেল পাশের গ্রামের লোক বলে সবার বাড়িতেই তাঁর প্রবেশাধিকার। আবু বাক্কার ভেতরে ঢুকে গেলেন। ডেকে আনলেন গৃহবধূ দেখন বালা বর্মনকে। তিনি তাঁর বাড়ির বাইরে দেয়ালে আকাশি রং দিয়ে তার ওপরে এঁকেছেন ফুল, পাখি ও লতাপাতা। দেয়ালের নিচের অংশ লাল রং দিয়ে আলাদা করেছেন। মেঝেটাও সুন্দর করে লেপা-পোঁছা।
দেখন বালার বয়স প্রায় ৪৫ বছর। ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন। লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি। আলপনা আঁকার কাজও কারও কাছে শেখেননি। মাটির দেয়ালের এই সৌন্দর্যের প্রতি তিনি এতই যত্নশীল যে বাইরে বারান্দার চালার সঙ্গে একটি পলিথিন বেঁধে রেখেছেন। বৃষ্টি এলেই তিনি বেঁধে রাখা পলিথিন খুলে দেন, যাতে বারান্দার রং ধুয়ে না যায়। শুধু তা-ই নয়, নিচের দিকে একটি জাল টেনে দিয়েছেন যাতে মুরগি বা ছাগল উঠে বারান্দা নষ্ট করতে না পারে।
দেখন বালা তাঁর বাড়ির ভেতর দেখার জন্য ডাকলেন। ভেতরে ছোট্ট উঠোন। তার এক পাশে গরুর ঘর, অপর পাশে শোবার ঘর। সেই ঘরের সামনে একটিই দেয়াল। সেই দেয়ালটি মনের মাধুরী মিশিয়ে এঁকেছেন দেখন বালা। আঁকার জন্য তাঁর রীতিমতো রং-তুলি রয়েছে। সেগুলো একটি পাত্রে গুছিয়ে রাখা।
পাশেই রণজিৎ বর্মনের বাড়ি। বাইরে থেকেই বোঝা যায়, তাঁর বাড়িও একই রকম পরিপাটি। বাড়ির বাইরেই ছিলেন রণজিৎ বর্মন। তিনিও একজন দিনমজুর। পাশাপাশি কীর্তনশিল্পী। কোথাও হরিবাসর হলে তিনি খোল বাজিয়ে গান করেন। এ ছাড়া তাঁর আয়ের কোনো উৎস নেই। জায়গাজমিও নেই। কিন্তু তাঁর বাড়ির দেয়ালে গোলাপ ফুল ফুটে আছে। তাঁর স্ত্রী অনিতা বর্মন এগুলো করেছেন। মেয়ে মীরা বর্মন দশম শ্রেণিতে পড়ে। সে এই আঁকার কাজ জানে কি না জানতে চাইলে বলে, সে মায়ের ‘হেলপার’। সে দেয়ালে একটি ডাইনোসর এঁকেছে। অনিতা বর্মন বললেন, ‘প্রতিবছর আমরা নতুন ছবি আঁকি।’
গ্রামের যুবক নিহার বর্মন বললেন, এটা আমাদের ঐতিহ্য। নাচোল উপজেলার ভেতরে টিকইল, সোনাইচণ্ডী, করমজা, আক্কেলপুর, গুনইর, বিশালপুর, জগ্গিশাইল, হাটবাকইল, নেজামপুর, বকুলতলা, মাকতাপুর, কলিহার, ডাঙ্গাপাড়া ইত্যাদি গ্রামের মাটির বাড়িতে এই আলপনা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।
রঞ্জনা বর্মনের বাড়িতে গিয়ে নতুন দৃশ্য দেখা গেল। তাঁর শোবার ঘরের দরজার পাশের দেয়ালে তিনি মুক্তিযুদ্ধের একটি দৃশ্য এঁকেছেন। তিনি বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। মানুষের মুখে শুনেছি, বইয়ে পড়েছি। তাই এঁকে রেখেছি।’