পরিবার

মায়ের স্বপ্নপূরণ!

ছেলের কাছে বেড়ানোর গল্প শোনেন মা। বিস্ময় ঝরে পড়ে মায়ের চোখে। ছেলের প্লেনে চড়ার কাহিনি শুনে একদিন মুখ ফসকে বলেই ফেললেন তাঁর শখের কথা। ছেলে চাইল মায়ের শখ পূরণ করতে। তিল তিল করে টাকা জমাতে শুরু করলেন ছেলে আবু সাঈদ। কাছের মানুষের নিশান, আর মায়ের কাছে নিশু। কদিন আগেই প্লেনে করে আগে থেকে ভ্রমণের সবকিছু না জানিয়ে মাকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে এসেছেন। করেছেন মায়ের স্বপ্নপূরণ। সেই অভিজ্ঞতাই লিখেছেন আবু সাঈদ

এ ঘর থেকে ওঘর করতে করতেই জীবনের ৫৩ বছর পার করে দিলেন মা সাহেরা খাতুন। জন্মের পর থেকে আমাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে করতেই হারিয়ে গেছে তাঁর নিজের সব শখ-ইচ্ছা, সাধ-আহ্লাদ। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার ছোট।

অল্প অল্প করে বড় করে তুলেছেন আমাকে। নিজে না খেয়ে খাইয়েছেন। সব সময় দিয়ে গেছেন, নিজে কখনো কিছু চাননি।

ছোটবেলা থেকেই বেড়াতে আমার ভালো লাগে। আমার এই ছোট জীবনে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে অনেক জায়গায় ঘুরেছি। প্রতিটি ভ্রমণ শেষে বাসায় এসে মাকে কাহিনি বলতাম। মা গভীর মনোযোগ দিয়ে সব শুনতেন। বিস্মিত হতেন। আমার মায়ের বড় একটা ব্যাপার, তিনি খুব কৌতূহলী।

মায়ের সঙ্গে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে সেলফি তুলছেন আবু সাঈদ

তিন বছর আগে একবার সিএফএসের (চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটি) হয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে প্লেনে করে কক্সবাজারে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে এসে যখন মাকে কী কী করলাম সেই কাহিনি বলছিলাম, তখন তিনি গভীর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। মূলত বিমানে ওঠার বিষয়টাই মাকে বেশ টেনেছিল। তাঁর চোখে মুখে ছিল অপার বিস্ময়। আমার প্লেনে ওঠার অভিজ্ঞতা শুনে তাঁরও খুব ইচ্ছা হলো তাতে চড়ার। মুখ ফসকে বলেও ফেলেছিলেন, ‘বাবা, আরে (আমাকে) একবার প্লেনে উঠাইস?’
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মাথায় এল, আচ্ছা! আমি তো জীবনে অনেক ঘুরেছি, আর সামনেও ঘুরব। কিন্তু আমার মা তো চিড়িয়াখানা আর শিশুমেলা ছাড়া এই জীবনে আর কোথাও যাননি। মনটা খারাপ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাকে নিয়ে বিমানে করে কক্সবাজারে যাব। মা-ছেলে দুজন মিলে সমুদ্রের পাড়ে বসে ভরা পূর্ণিমায় জ্যোৎস্নাবিলাস করব। সমুদ্রের এমাথা থেকে ওমাথা ঝিনুক কুড়াব আর ঘুরব।
তারপর থেকেই শুরু হলো স্বপ্নের চারা বোনা। যেভাবে প্ল্যান করেছি, তাতে মাকে নিয়ে বিমানে করে কক্সবাজারে গিয়ে মারমেইড রিসোর্টে থাকাসহ বেশ ভালো পরিমাণ টাকা লাগবে। কিন্তু আমি তো সবেমাত্র কলেজ জীবন শেষ করেছি। টিউশনি ছাড়া কিছুই করি না। এত টাকা পাব কই?

টুকটাক টাকা জমানো শুরু করলাম। কিছু টাকা জমে আবার কোনো না কোনো কারণে শেষ হয়ে যায়। আবার জমে, আবার কোনো না কোনো ঝামেলা লাগে। তারপর দুই বছর পর ছোটখাটো একটা চাকরি হলো আমার। তখন যেটা হলো—টাকা হয়, সময় হয় না। সময় হয়, টাকা হয় না। এভাবে করতে করতে আরও একটা বছর চলে গেল। অবশেষে প্রায় তিন বছর পর গত ঈদের সময় ‘বোনাস ও পুরো মাসের বেতন মিলে’ যেভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম, সে পরিমাণ টাকা আর অবশ্যই সময় বের করা সম্ভব হলো।

এদিকে মা যদি জানতেন, আমি এত টাকা খরচ করে কক্সবাজারে যাচ্ছি, কখনোই যেতে তিনি রাজি হতেন না। তাই তাঁকে তেমন কিছুই জানাইনি। অনেকটা সারপ্রাইজের মতো! শুধু বলা হয়েছিল, আমরা দুজন প্লেনে করে ঘুরতে যাব। তারপরও তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। পরে অনেক কষ্টে তাঁকে রাজি করালাম। ইচ্ছা ছিল বাবাকেও নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু বাবা অসুস্থ থাকায় তাঁকে ​ি​নয়ে বেড়ানো হলো না।

শেষমেশ সব চূড়ান্ত হলো। ২২ সেপ্টেম্বর আমি আর মা নভোএয়ারের উড়োজাহাজে চেপে বসলাম।

মায়ের প্রথম বিমানে চড়া

আমাদের গন্তব্য কক্সবাজারের মারমেইড বিচ রিসোর্ট। মা বিমানে উঠেই প্রথম আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের ছোটাছুটি দেখে বিস্মিত হলেন। এত দিন যে মেঘ তিনি মাথা উঁচু করে দেখেছেন, আজ তিনি সেটা মাথা নিচু করে দেখছেন। গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। যেতে যেতে প্লেন যখন আকাশের অনেক ওপরে উঠে গেছে, তখন তাঁর মনে হয়েছে, আমাদের প্লেন থেমে আছে! তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘ওমা! প্লেন দেই থামি আছে! চলে না ক্যা?’ আমি আশ্বস্ত করলাম, ‘না মা, প্লেন চলছে। অনেক দ্রুতই চলছে।’ কিন্তু মায়ের চেহারা দেখে মনে হলো, তিনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। উল্টো বলতে থাকলেন, তিনি নিচ থেকে যখন প্লেন দেখতেন, তখন তো সেটা অনেক দ্রুত চলত। এখন এমন থেমে আছে মনে হচ্ছে কেন?

মারমেইড বিচ রিসোর্টে দোলনায় দুলছেন মা

তারপর আমরা যখন সৈকতে সাগরের পানিতে হাঁটু পর্যন্ত পা ডুবিয়ে দূরের ওই আকাশটা দেখছিলাম, তখন তিনি আমাকে বলছিলেন, ‘নিশু (মা আমাকে এ নামে ডাকেন), আকাশ না উপরে থায়? আকাশ সমুদ্রের লগে এইক্কান লাগি গেছে ক্যা? ঐ আকাশতোনই বুঝি সমুদ্রের হানি ইগিন আইয়ে?’ আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।
ও হ্যাঁ, শুধু তা-ই নয়, সমুদ্রের ঢেউ চলে যাওয়ার পর পায়ের নিচ থেকে যে বালু সরে গর্ত হয়ে যাচ্ছিল, তা নিয়েও তাঁর বিস্ময়ের শেষ নেই। ঢেউ এলেই তিনি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকতেন।
কক্সবাজারের রামুর ১০০ মিটার লম্বা বুদ্ধমূর্তি যে মানুষ বানাতে পারে, সেটাও তাঁর কাছে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তাঁর ধারণা, এত বড় মূর্তি মানুষ কেমনে বানাবে? যেটার হাত দেখতেই চল্লিশটা হাতের সমান।

আর সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল দুটি—একটি হলো, মায়ের কাঁটা চামচ দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করা (পরে যদিও হাত দিয়েই আরাম করে খেয়েছেন)। দ্বিতীয়টি হলো, ফেরার সময় গ্রিনলাইনের এসি বাসে। তিনি বাসের জানালা খুলতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি যখন তাঁকে বললাম, ‘মা, এসি গাড়িতে তো জানালা খোলা যায় না।’ তখন তিনি আমাকে বকা দিয়ে বললেন, ‘এত দাম দি কিয়ের গাড়িতে উইসসত, যে গাড়িন জানলাই খোলা যায় না!’

মায়ের এসব কৌতূহল ও জিজ্ঞাসায় আমি একটুও বিরক্ত না হয়ে আনন্দ পাচ্ছিলাম। খুব ভালোভাবে তাঁকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। যতবার বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম ততবার মনে অসম্ভব তৃপ্তি ও শান্তি পাচ্ছিলাম। এর চেয়ে শান্তি পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না আমার জানা নেই।

মায়ের সঙ্গে ফেলা প্রতিটি কদমে যে অফুরন্ত ভালোবাসা ও শান্তি পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই পাওয়া সম্ভব নয়। আমার এই জীবনের সবচেয়ে সেরা দুটি দিন কাটিয়েছি। এই ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ আমি কখনোই করতে পারব না। আসলে কোনো সন্তানই করতে পারবে না। অসম্ভব।

কক্সবাজার থেকে ফিরে আসার পর মা সবাইকে পুরো ভ্রমণের গল্পটা বলছিলেন। আর আমি তা দেখছিলাম। তাঁর চোখে-মুখে আনন্দ আর তৃপ্তি। ঠিক তখন প্রাণটা জুড়িয়ে যাচ্ছিল। আহা! জীবনটা সার্থক!