
ছাত্রের বাবা বললেন, ‘দেখো, আমার ছেলের শহরে জন্ম, শহরে বাস। গ্রাম-বাংলার কিছুই তো চিনছে না। একটু একটু করে চেনাও। সেদিন টাকি মাছ নিয়ে এসেছি, নাম শুনে হেসেই খুন। বলে কি জানো? টাকি নাকি মানুষকে টিটকিরি করে বলা হয়।’
সালেকিন মনে মনে ছাত্রের প্রশংসা করে। এ যুগের হাওয়া বোঝে। সালেকিনের বন্ধুদের মধ্যেই তো আছে এক টাকি। আরে, ওই যে জাফরুল, এ বয়সে কত কী করে ফেলল! সবাই বলে ‘টাকি পোলা’!
সালেকিনকে ঝিম মেরে থাকতে দেখে ছাত্রের বাবা কী বুঝলেন, বললেন, ‘ডোন্ট ওরি, তোমাকে এ জন্য বাড়তি কিছু দেব।’
সালেকিন বলে, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’
অষ্টম শ্রেণির ত্বরণকে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি মাৎস্যবিদ্যায় তালিম দিতে শুরু করে সালেকিন। কিন্তু সালেকিন শেখাবে কী, ছাত্র উল্টো ওকে বেকায়দায় ফেলে। বলে, ‘মাডস্কিপার ফিশ চেনেন, স্যার?’
ঠিক এ সময় ত্বরণের খালা পুনম এসে ঢোকে। গায়ে সুবাস, চোখে অজানা ভাষা, হাতে চা-বিস্কুটের ট্রে। দর্শনে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। সালেকিন খেয়াল করেছে, পড়ানোর সময় যখন ও কিছুতে ঠেকে যায়, ঠিক এ সময় আগমন ঘটে তার। এ মেয়ে কি আর সময় খুঁজে পায় না!
‘বলেন না, ওই মাছটা চেনেন, স্যার?’ তিরের মতো তাকিয়ে ত্বরণ। উত্তর চাই।
সালেকিন বোঝে—ঠিক হচ্ছে না, তবু মাথা চুলকায়। এ ছাড়া আর করবে কী?
পুনম বিজ্ঞের মতো বলে, ‘ও, লাফিয়ে চলা মাছটার কথা বলছিস? ওই যে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে দেখাল?’
‘হ্যাঁ, খালামণি।’
‘উনি ওই মাছ চিনবেন কী করে? ওটা আফ্রিকার মাছ। ক্লাইম্বিং ফিশ। আমাদের দেশে এমন মাছ নেই।’
সালেকিন বলে, ‘আপনি দেখছি মাছ খুব ভালো চেনেন!’
: তা বলতে পারেন। হাঁটুজল থেকে গভীর জলের অনেক মাছই চিনি।
কথার ঢঙে ঢোঁক গেলে সালেকিন। ত্বরণ সোৎসাহে বলে, ‘খালামণি ধাঁধাও খুব ভালো পারেন। একটা দিলে জট খুলতে পারবেন না, স্যার। একটা দাও না, খালামণি।’
: না থাক। উনি মাইন্ড করবেন।
: না না, মাইন্ড করব কেন, দিন না।
: আচ্ছা, ঠিক আছে। গ্রামাঞ্চলের একটা ধাঁধা দিই। বলুন তো ‘ভিতরে ছিলাই ওপরে খাই’—এটা কী?
সালেকিনের মনে হয় কঠিন আঠা দিয়ে ওর ঠোঁটজোড়া আটকে দিয়েছে কেউ। পুনম মুখ টিপে বলে, ‘ঠিক আছে, কালকে বললেও হবে। এক দিন সময় দিলাম।’
ছাত্র পড়ানো শিকেয় ওঠে সালেকিনের। বেরিয়ে আসার পর মনে পড়ে—আরে, দেশে ক্লাইম্বিং ফিশ আছে তো! কই মাছ। দূর, পুনমকে পিছল খাওয়ানোর সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল। কালকে ধরতে হবে। কিন্তু ‘ভিতরে ছিলাই’ জিনিসটা কী?
নীলখেতের বইয়ের দোকানগুলো হাতড়ে দু-চারটা ধাঁধার বই কিনে ফেলে সালেকিন। না, একটাতেও নেই। পত্রিকা থেকে কেটে কুইজ পাঠায়—এমন এক ফুপাতো বোনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে ও। সেও জানে না। তবে বোনটি প্রশ্ন করতে ছাড়ে না, ‘তোমার ভেতরটা এমন ছিলতেছে কে, ভাইয়া?’
জবাব দেওয়া হয় না সালেকিনের। মনে মনে বলে, ‘ধাঁধা দিয়া বুকে এ কোন তির মারিলা?’
সালেকিন ঠিক করে, পড়াতে আর যাবেই না। তিরের খোঁচা উসকায়—যা যা, ১০০টা ধাঁধা পার না হলে সাধন হয় না।
পরদিন যথাসময়ে সালেকিন ত্বরণদের বাসায় হাজির। ফিচেল ছাত্র শুরুতেই বলে, ‘ধাঁধার উত্তরটা পেয়েছেন, স্যার?’
সালেকিন চেহারা শক্ত করে বলে, ‘পড়ার সময় এসব কী! ফালতু কথা নয়, পড়ায় মন দাও।’
টেটনা ত্বরণ ভাব নিয়ে বলে, ‘না, খালামণি এলে আপনি আবার বিপদে পড়বেন কি না, তাই ভাবছিলাম আগেভাগে উত্তরটা বলে দিই। উত্তরটা জানি তো।’
নিমেষে ঘাড় খাটো হয়ে যায় সালেকিনের। সাগ্রহে জানতে চায়, ‘বলে ফেলো।’
: ওটা মুরগির গিলা, স্যার। ভেতর ছিলে ওপরে খায়। আমি যে বলেছি, খালামণিকে আবার বলবেন না যেন।
: মাথা খারাপ! তবে তোমার খালামণি ব্রিলিয়ান্ট!
: হ্যাঁ, খুবই। উনিই তো এখন আমাকে বিভিন্ন রকমের মাছ চেনাচ্ছেন। খালামণি শেখায়ও দারুণ! উনি একবার কোনো মাছ চেনালে জীবনেও ভুলবেন না।
: কী রকম, শুনি।
: যেমন ধরুন, আমার বাহার আংকেল, যাঁর অনেক টাকাপয়সা আর ক্ষমতা, উনি হলেন রাঘববোয়াল। আমাদের পাশের বাসার বাশার আংকেল, যিনি ইয়া বড় ভুঁড়ি বানিয়েছেন, খালামণি বলেন উনি পটকা মাছ। আর...
এটুকু বলে আর এগোতে পারে না ত্বরণ। পুনমের কাশি ওকে থামিয়ে দেয়। ট্রে হাতে ঠিক হাজির। সালেকিন বহু কষ্টে উচ্ছ্বাস চেপে বলে, ‘আপনার ধাঁধার উত্তরটা পেয়ে গেছি!’
: বলে ফেলুন।
: ওটা মুরগির কলিজা।
হাসতে হাসতে বাঁকা হয়ে যায় ত্বরণ। পুনমকে লারা ক্রফট্: টুম্ব রেইডার ছবির অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মতো লাগে লালটুস সালেকিনের। দুই হাতে দুই পিস্তল। সত্যিই সে যেন গুলি ছোড়ে, ‘ওটা কলিজা নয়, স্যার। গিলা। ত্বরণ বলে দেওয়ার পরও জবাবটা দিতে পারলেন না।’
এরপর বাকি সময়টা সালেকিন কীভাবে পার করল, তা না বললেও চলে। তবে সেদিন রাতে ওর মুঠোফোনে একটা খুদে বার্তা আসে। ওতে লেখা, ‘ইউ আর আ মেনি মাছ। আই লাইক ইট!’